ইসলামের অস্তিত্বের সংগ্রাম বদরের যুদ্ধ

শামসুল ইসলাম সাদিক: আজ থেকে প্রায় এক হাজার ৫০০ বছর আগে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ, ২ হিজরির ১৭ রমজান মদিনার মুসলিম ও মক্কার অমুসলিমদের মধ্যে সংঘটিত হয় সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী যুদ্ধ, ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম রক্তঝরা মহাসংগ্রাম ‘বদরের যুদ্ধ’। মদিনা উপকণ্ঠ থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বদর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের আগে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধ হয়। কিন্তু বদর ছিল দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসুল (সা.) আল্লাহর দরবারে আরজ করেন, ‘হে আল্লাহ, এই কাফিররা চরম ঔদ্ধত্য ও অহমিকা নিয়ে এসেছে তোমার রাসুলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে। অতএব, আমায় যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছিলে, এখন সে সাহায্য পাঠাও। হে আল্লাহ, আজ এই মুষ্টিমেয় দলটি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ায় তোমার বন্দেগি করার আর কেউ থাকবে না।’ ইসলামের এ প্রথম সামরিক যুদ্ধে রাসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। মুসলিমদের এই বিজয় অন্যদের কাছে এই বার্তা পৌঁছায় যে, মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বিজয়ের ফলে রাসুল (সা.)-এর অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়। রাসুল (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর দীর্ঘ ১৩ বছর অতিবাহিত করেন মক্কায়। এরপর তিনি আল্লাহর হুকুমে মক্কায় বসবাসরত সাহাবিদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের দ্বিতীয় বছরেই রাসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে গঠিত মদিনা রাষ্ট্রটি মক্কার কাফের শক্তির পক্ষ থেকে হুমকির মুখোমুখি হয়। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মক্কার কাফেরদের একটি বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম শক্তির প্রতিরোধের মুখে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মক্কা থেকে এক হাজার কাফের সেনার একটি সশস্ত্র দল মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘বদর’ ময়দানে এসে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করে। এ অবস্থায় মাত্র ৩১৩ সাহাবিকে নিয়ে বদর ময়দানে উপস্থিত হন রাসুল (সা.)। রাসুল (সা.) স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করেন। আল আরিসা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপন করা হয়। ফলে পানির কূপগুলো তাদের আয়ত্তে ছিল। রাসুল (সা.) সেনা সমাবেশের জন্য এমন একটি জায়গাই বেছে নেন, যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ হলে কোনো মুসলমান সেনার চোখে সূর্য কিরণ পড়বে না। অমুসলিমদের সেনাসংখ্যা এক হাজার। তাদের ছিল ১০০টি ঘোড়া, ৬০০টি লৌহবর্ম এবং অসংখ্য উট। অমুসলিমদের সেনাপতি ছিল ওতবা বিন রবিআ। যুদ্ধে ৭০ জন অমুসলিম নিহত হয় এবং বন্দি হয় ৭০ জন। মুসলিম বাহিনীতে সেনাসদস্য ছিলেন ৩১৩ জন এবং মুহাজির ছিলেন ৮২ জন। বাকি সবাই আনসার। আওস গোত্রের ৬১ জন এবং খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন। মুসলিমদের উট ও ঘোড়ার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭০টি ও দুটি। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শাহাদাত বরণ করেন। বদরের যুদ্ধে দুই কিশোর হজরত মাআজ ও মুআ ওয়াজ (রা.)-এর হাতে ইসলামের প্রধান শত্রু আবু জাহেলের নিহত হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। বদরের প্রান্তে যদি মুসলমানরা জয়ী না হতেন, ফলাফল কী হতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুসলমানদের পৃথিবী থেকে নিঃশেষ করার যে অভিপ্রায় নিয়ে নকশা আঁকছিল মক্কার কাফেররা। আল্লাহর একত্ববাদের স্বরদকে স্তিমিত করতে তারা কৌশল আঁটে। গোত্রে-গোত্রে লাত-মানাতের দোহাই দিয়ে যুদ্ধের সংবাদ পাঠায়। তখন মদিনায় সাড়া পড়ে যায়। এক আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার তাগুতি শক্তির কবল থেকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের ঘোষণা দেন রাসুল (সা.)। মদিনার গলিতে গলিতে তখন উৎসব। নিজেকে আল্লাহর সম্মুখে উৎসর্গ করার মোক্ষম সুযোগ পেল সৌভাগ্যবানরা। শহিদ হওয়ার আকাক্সক্ষায় উদ্বেল একেকটি মন। অন্তরে জেগে ওঠে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রেম। তাঁরা বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমরা আপনার প্রতি ইমান এনেছি, আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা সবই সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছি, সর্বোপরি আপনার আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। অতএব, আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই কাজে পরিণত করুন। আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে গিয়েও ঝাঁপ দেন, তবু আমরা আপনার সঙ্গে থাকব এবং এ ব্যাপারে একটি লোকও পিছিয়ে যাবে না। আমরা যে শপথ নিয়েছি, যুদ্ধকালে তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আমরা যেকোনো মূল্যে শত্রুর মোকাবিলা করব। খুশি হন মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)। বাহ্যত দুর্বল, ক্ষীণকায় সবদিকে পেছানো মুসলমানদের ঈমানের জ্যোতির কারণে আল্লাহ ঘোষণা দেন তাঁদের বিজয়ের। আসমান থেকে ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্যের। এ যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করলেন। কাফিরদের দাপট ধুলায় মিশিয়ে দিলেন। চিরদিনের জন্য তাগুতি শক্তির অসারতা প্রমাণিত হলো। যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর হুকুম মেনে যুদ্ধ করার কারণে বিজয় এসেছিল। দুনিয়ার বুকে এ কথা প্রতিষ্ঠিত হলো যে, মুসলিম জাতি যদি বদরি সাহাবিদের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রেমের পরিচয় দিতে পারে, তবে দুনিয়ার কোনো শক্তি তাদের ক্ষতি করতে পারবে না।

বদরের সাহাবায়ে কেরামরা কাফিরদের তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে যেভাবে নিজেদের আত্মনিয়োজিত করেছেন, ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। মদিনার অন্য আরব গোত্রগুলো মুসলিমদের নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। যুদ্ধজয়ের ফলে রাসুল (সা.)-এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বদরের যুদ্ধের বিজয় আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে, বাতিল যত শক্তিশালী হোক না কেন, মুসলমানরা যদি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর হুকুম মেনে ঐক্যবদ্ধভাবে বাতিলকে রুখে দাঁড়ায়, তাহলে বিশ্বের যে কোনো অপশক্তিই ঈমানদারদের কাছে পরাজিত হবে। বদরের যুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক নিদর্শন ও অনুপ্রেরণা লাভের অন্যতম শিক্ষা। এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এটা প্রমাণ করে যে সত্যনিষ্ঠ কাজে বিজয়ের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ়তা, ধৈর্য ও সহনশীলতার বিকল্প নেই। রমজান মাসে আমাদের প্রার্থনা আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে যেকোনো কাজে সফলতা লাভে কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প, ধৈর্য ও সহনশীলতা পোষণের তৌফিক দান করুন, যেভাবে তিনি বদর প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীকে তাঁর রহমত দান করেছিলেন। আমিন।

মুদ্রণ ব্যবস্থাপক

দৈনিক সিলেটের ডাক

sadiqsamsul1@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০