ইসির ক্ষমতা রহিত হয়নি বেড়েছে: সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক :গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের ফলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ‘আরও বেড়েছে ও সুসংহত হয়েছে’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলছেন, ওই সংশোধনের ফলে ভোট শেষে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ভোট বাতিল এবং গেজেট প্রকাশ আটকে দেয়ার ক্ষমতা পেয়েছে ইসি।

ওই সংশোধনের ফলে ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা ‘খর্ব হয়েছে’ বলে যে বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসছে, তার কড়া সমালোচনা করেছেন সিইসি।

তিনি বলেন, ভোট বন্ধে ইসির কোনো ক্ষমতা ‘রহিত হয়নি’, বরং আরপিও সংশোধন নিয়ে জনগণকে ‘বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, ইসিকে হেয় করা হচ্ছে’।

আরপিও সংশোধন গেজেট প্রকাশের পর গতকাল সোমবার সার্বিক বিষয় নিয়ে নির্বাচন ভবনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন সিইসি। নির্বাচন ভবনে সিইসির কক্ষের সামনে এ ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

‘বিভ্রান্তি দূর করতে’ ব্রিফিং: সিইসি বলেন, দীর্ঘ কয়েক মাসে আইনটি নিয়ে নানা বক্তব্য এসেছে। তাতে জনগণ ‘বিভ্রান্ত হতে পারে’। যেসব ব্যাখ্যা, মন্তব্য এসেছে ‘তার সব সঠিক নয়’। ইসি বিষয়টি স্পষ্ট করতে চায়।

“কমিশন ‘বুঝে না বুঝে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মেরেছে’Ñএমন মন্তব্য এসেছে। বলা হয়েছে, গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল, ৯১ এ দফায় সংশোধন হয়েছে। সরকার নিজের সুবিধার জন্য আইন সংশোধন করেছেÑএমনও কথা হয়েছে। এগুলো নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। সরকার আরপিও সংশোধন আমাদের প্রস্তাবমতো করেছে। ইসি তার অবস্থানকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য সংশোধনগুলো চেয়েছিল, সরকার সম্মত হয়েছে। সংসদ সম্মত হয়েছে। এতে করে আমাদের ক্ষমতা বর্ধিত হয়েছে।”

ইসি নিজেই কমিশনের ‘ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব’ করেছেÑএমন দাবি ‘অবান্তর’ মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব পাঠাতে পারে না ইসি। জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হন, তাই আমাদের অবস্থানটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’

সমালোচকদের উদ্দেশে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আরপিও সংশোধন নিয়ে ‘অপব্যাখ্যা’ করা হচ্ছে, এটা ‘দুঃখজনক’।

‘আমরা পুরো জাতি একটা সুন্দর নির্বাচন চাই। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে ইসিকে হেয় করা বাঞ্ছনীয় নয়। কমিশনকে গঠনমূলক সাজেশন দিয়ে সহায়তা করলে আমরা উপকৃত হব।’

ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা রহিত করা হয়নি বলে দাবি করে সিইসি বলেন,

 “পরিস্থিতি অনুযায়ী কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে আইনকানুন, রুলিং অনুযায়ী। ‘ইলেকশনের’ পরিবর্তে যেহেতু ‘পোলিং’ এসেছে, এটা আপনাদের মতো আপনারা বোঝেন; আমরা আমাদের মতো বুঝেছি। আপনারা যেভাবে বুঝেছেন, বুঝতে থাকেন। আমরা কী করতে পারব, আমরা জানি। আপনারা চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।”

যা চেয়েছে তা পায়নি: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একগুচ্ছ সংশোধন প্রস্তাব করে ইসি। ৪ জুলাই বিলটি সংসদে পাস হয়। ভোট শেষে সরকারি ফলাফল গেজেট প্রকাশ ছাড়া কিছু করার না থাকলেও অনিয়মের অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে পুরো নির্বাচনী আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল ইসি। কিন্তু সংশোধনে ভোটের পর ফলাফল স্থগিতের ক্ষমতা দিলেও শুধু অভিযোগ আছে, এমন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবগুলো ১১ মাস আগে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বেশ চড়াই-উতরাই পার হয়ে তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়।

“তাতে সামান্য পরিবর্তনও করেনি। ইসির মতামত নিয়েছে, বিশেষ করে ৯১এএ নিয়ে। আমরা বলেছিলাম, (অনিয়মের কারণে) যে কোনো পোলিং সেন্টার বা পুরো নির্বাচনী এলাকা (বাতিলের) বিধান। আমাদের মতামত চেয়েছেÑযেখানে প্রভাবিত হবে, যে কেন্দ্রগুলোতে বাধাগ্রস্ত হবে, সে কেন্দ্রগুলো বাতিল করে দেয়া হোক। আমরা সম্মত হয়েছি, এটা যৌক্তিক। এটি সম্পূর্ণ নতুন ধারা।”

সিইসি জানান, ৯১-এ ধারায় কমিশন কোনো পরিবর্তন প্রস্তাব করেনি। সংশোধনীতে নতুন ধারা ‘৯১এএ’ সংযোজিত হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবে সংসদ থেকেও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

বিরোধীদের আপত্তির মুখে আরপিও সংশোধনী বিল পাস: ৯১এ ও ৯১এএ নিয়ে সিইসির জবাবÑগণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতিপ্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোটগ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।

এই ধারায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি বলে দাবি করে সিইসি বলেন, ‘৯১এ ধারায় কোনো পরিবর্তন যদি হতো, তাহলে আমাদের ক্ষমতা হেরফের হতো। সেখানে কিছু করা হয়নি। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যেখানে পোলিং পিরিয়ডে আমরা যে কোনো একটি, দুটি কেন্দ্র বা সমস্ত কন্সটিটিউয়েন্সির আমরা বাতিল করে দিতে পারব। সে ক্ষমতা হুবহু আগের মতো রয়েছে।’

সংশোধনে নতুন দফা ৯১এএ সংযোজনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তার ফল সরকারিভাবে আমাদের কাছে পাঠানোর পরে ইসির গেজেট করা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না।

‘সেখানে আমরা বলেছিলাম, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তারপরও কোনো কেন্দ্র বা কোনো কনস্টিটিউয়েন্সি নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কমিশন বিষয়টি তদন্ত করে করতে পারবে গেজেট উইথহেল্ড করে রেখে।’

‘সেখানে সংসদ বলেছে, আমরা গেজেট উইথহেল্ড করতে পারব, সেক্ষেত্রে কনস্টিটিউয়েন্সির নির্বাচনটা বাতিল না করে যে যে কেন্দ্রে ফলাফল বাধাগ্রস্ত হয়েছে মনে করবে, সেসব কেন্দ্রে ফলাফল বাতিল করতে পারবেÑএতটুকু।’

সমালোচকদের একহাত: ৯১এ ধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের পরিবর্তে ‘পোলিং’ শব্দটি ব্যবহারে ভোটে ইসির ক্ষমতা কমেছে বলে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলে এসেছেন। তবে সিইসি দাবি করছেন, এটা ‘অপব্যাখ্যা’।

সিইসি বলেন, “আমরা তিনটি জায়গায় ‘ইলেকশন’ শব্দটাকে ‘পোলিং’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছি। এটা হচ্ছে ক্লারিক্যাল কারেকশন। কারেকশন আর অ্যামেন্ডমেন্টের মধ্যে ফারাক রয়েছে।

“অ্যামেন্ডমেন্টের মধ্যে নীতিগত এলিমেন্ট থাকে, কারেকশনটা হচ্ছে জাস্ট সংশোধন। এটাকে নিয়ে অপব্যাখ্যা করাটা দুঃখজনক মনে করি।”

তিনি বলেন, “আরপিও ‘ইলেকশন’ ও ‘পোলিং’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটাকে বড় করে দেখা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নিজের পায়ে কুঠার মেরেছে বলা হচ্ছে। ইসির লিগ্যাল সাইড আছে। ইলেকশন শব্দটা হচ্ছে জেনাস, ইলেকশনের আন্ডারে পোলিং; পোলিংয়ের আন্ডারে ইলেকশন হয় না। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াটাকে পোলিং বলা হয়। এটা ইলেকশন হবে না, পোলিং হবে।

তিনি বলেন, “অপব্যাখ্যা দুঃখজনক। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার জন্য কাজ করব, এটা অবান্তর মন্তব্য। কমিশন ভুল করতে পারে, কিন্তু নিজের পায়ে কুড়াল মারেনি।”

সিইসি বলেন, “সরকার আমাদের সম্মান করেছে। যে যে সংশোধন চেয়েছিলাম, তাতে সম্মত নাও হতে পারতেন। আমরা যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাতে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। আমাদের প্রস্তাব পাস হয়েছে। জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হন, আমাদের অবস্থানটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”

ভোটের আগে নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কী ব্যবস্থা নেবেনÑএমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “নতুন আইনটা হয়নি, এটা ছুড়ে ফেলে দিন। ভোটের আগে এরকম পরিবেশ হলে আমরা কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব। স্পষ্ট করে বলতে চাই, ৯১এ-তে ইসির ক্ষমতা রহিত হয়নি।”

৯১এ নিয়ে বারবার প্রশ্নের কারণে কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে সাংবাদিকদের চিন্তাভাবনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।

যে কোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধের ক্ষমতা রয়েছে: সিইসি বলেন, ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ ব্যবহার করায় কোনো হেরফের হবে না। বিদ্যমান বিধান দিয়েই প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে ইসি।

তফসিল ঘোষণার পর অনিয়ম বা ভোটের পরিবেশ না থাকলে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “আমি কোনো হাইপোথিটিক্যাল বিষয়ে যাব না। ওই ধরনের পরিবেশ হলে কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে। সুযোগ নেই কেন? কোথায় নেই? ভোটের আগের দিন যদি পরিস্থিতি হয় (এই কারণে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবেন, এ কারণে পারবেন না বিধান রয়েছে)। তারপর যদি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, কমিশন করবে না কেন? এটা নিয়ে এ গবেষণার প্রয়োজন হলো কেন বুঝলাম না।”

তিনি বলেন, “পোলিং চলছে যখন তখন আমরা প্রয়োগ করব ৯১এ দিয়ে। ৯১এএ বিষয়টা আসবে যখন ভোট শেষ হয়ে যাবে, তারপরও যদি মনে করি, অতি বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো সেন্টারে ফলাফল স্থগিত রেখে তদন্ত করতে পারব।”

ভোট শুরু হওয়ার আগে কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ভূমিকম্প হয়ে ৫০ লাখ লোক মারা গেল ধরুন, ইসির ইনহারেন্ট পাওয়ার আছে তাহলে পারবে না কেন? প্রয়োজন হলে পারবে না কেন?”

কমিশন চাইলেই যে কোনো সময় নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে বলে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, “বিদ্যমান আইনেই এটার সুযোগ রয়েছে।”

আরও যত সংশোধনÑসিইসি বলেন, ৯১এ এএ ছাড়াও আরপিওতে আরও কিছু সংশোধন এনে ইসির ক্ষমতাকে ‘সুসংহত’ করা হয়েছে।

গণমাধ্যকর্মী, পর্যবেক্ষকদের কাজে বাধা দিলে অপরাধ বিবেচনায় শাস্তির বিধান যোগ হয়েছে। ভোটে বাধা দিলে, ভোটারকে কেন্দ্রে আসার পথে বাধা দিলে, মনোনয়নপত্র জমায় বাধা ও প্রত্যাহারে চাপ দিলে শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি তার ক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে। ভোটের দায়িত্বে থাকা এ কর্মকর্তা সংশ্লিষ্টদের সহায়তা না পেলে কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দিতে পারবে। অনিয়মের কারণে ব্যবস্থা না নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হবে।

ব্যালট পেপারের পেছনে সিল করার পাশাপাশি স্বাক্ষরের বিধানও রাখা হয়েছে। কারচুপি রোধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে নতুন দফা যুক্ত হয়েছে।

প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ইসির রয়েছে। এখন নতুন বিধান হয়েছে, কারও প্রার্থিতা বাতিল হলে ওই প্রার্থী আবার সেই নির্বাচনে সেখানে নতুন করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০