রহমত রহমান: দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী সংগঠন। আর এসব সংগঠনের নেতৃত্ব দেন দেশের বড় ব্যবসায়ী। সংগঠনের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ৪৮৫ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। অথচ এসব ব্যবসায়ী সংগঠনের নেই ই-টিআইএন, জমা দেয় না আয়কর রিটার্ন। আবার এসব সংগঠনের সদস্যভুক্ত ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগের ই-টিআইএন। অনেকের ই-টিআইএন থাকলেও রিটার্ন দেয় না। দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সদস্যভুক্ত এসব চেম্বার, সমিতি ও অ্যাসোসিয়েশন এবং তাদের সদস্যদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।
ব্যবসায়ী এসব সংগঠনের ই-টিআইএন নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল ও কর আদায় নিশ্চিত করতে নতুন আয়কর আইনে কোম্পানির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর সদস্যদের ই-টিআইএন নিবন্ধন ও রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে অর্থ আইন সংশোধন করা হয়েছে। নতুন করদাতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে এফবিসিসিআইভুক্ত ৪৮৫ সংগঠন ও এসব সংগঠনের প্রায় দুই হাজার সদস্যকে ই-টিআইএন নিবন্ধন ও রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে সহযোগিতা চেয়ে এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর গঠিত জরিপ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। একই সঙ্গে এসব সংগঠনকে পৃথকভাবে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এফবিসিসিআই’র তথ্যমতে, সারাদেশে ৫২৩টি চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন এফবিসিসিআই’র সদস্য। সদস্য সংখ্যা সারাদেশে চেম্বার, সমিতি ও অ্যাসোসিয়েশন এফবিসিসিআই’র সদস্য। এর মধ্যে বিভাগীয় ও মেট্রোপলিটন চেম্বার রয়েছে ৭৩টি। জয়েন্ট চেম্বার ২০টি, উইমেন চেম্বার ১৫টি ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে ৪১৫টি। এসব চেম্বার, সমিতি ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
এনবিআর সূত্রমতে, জরিপসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল, ঢাকার কর কমিশনার কবীর উদ্দিন মোল্লা এবং টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ও এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (কর-১৫) মীর মো. আরিফ হোসেন সই করা চিঠি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রতিটি অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার, সমিতির প্রেসিডেন্ট অথবা মুখ্য কর্মকর্তা এবং অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার ও সমিতির প্রতিটি সদস্যকে পৃথকভাবে এ চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন, সমিতি এবং এসব সংগঠনের সদস্যদের ই-টিআইএন নিবন্ধন নেয়া ও রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্টের সহযোগিতা চেয়েছে টাস্কফোর্স।
চিঠিতে প্রতিটি চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন ও সমিতি এবং এসব সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলা হয়, আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২(৩১)(ঙ) এর সংজ্ঞাভুক্ত কোম্পানি হিসাবে প্রযোজ্য কর সার্কেলগুলো হতে ই-টিআইএন গ্রহণ, আয়কর রিটার্ন দাখিল এবং নিজ নিজ চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের নিজস্ব ই-টিআইএন থাকা এবং যথাসময়ে অর্থাৎ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রযোজ্য কর সার্কেলগুলোয় আয়কর রিটার্ন দাখিল ও আয়কর পরিশোধের অনুরোধ করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২ (৩১)(ঙ)-তে শিল্প ও বাণিজ্যিক সংগঠনকে কোম্পানির সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনের ধারা ২৬৪ (১১)-তে এসব পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের ই-টিআইএন গ্রহণ ও আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আয়কর আইন অনুযায়ী, এফবিসিসিআইভুক্ত এসব গঠন ও সংগঠনের সদস্যদের ই-টিআইএন গ্রহণ এবং আয়কর রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্টের সহযোগিতা কামনা করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি আয়কর আইন, ২০২৩ জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর বর্তমানে এই আইন কার্যকর হচ্ছে। আইনের ধারা ২ (৩১)(ঙ) অনুযায়ী-কোম্পানি অর্থ কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ (১৯৯৪ সালের ১৮ নং আইন) এ সংজ্ঞায়িত অর্থে কোন কোম্পানি ইহার অন্তর্র্ভুক্ত হবে। ‘যেকোনো শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন, ফাউন্ডেশন, সমিতি, সমবায় সমিতি এবং যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’।
এফবিসিসিআই ও এফবিসিসিআইভুক্ত সংগঠনগুলোকে উদ্দেশ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ধারা ২ (৩১)(ঙ) অনুযায়ী আপনার সংগঠনের নিজস্ব একটি করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার বা ই-টিআইএন থাকবে। আপনি আপনার সংগঠনের পক্ষে যথাসময়ে যথা নিয়মে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন। একই সঙ্গে আপনার সংগঠনভুক্ত সব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন, এসব সংগঠনভুক্ত সদস্যদের নিজ নামে ই-টিআইএন গ্রহণ করবে। এবং তারা যে কর সার্কেলের অধিক্ষেত্রাধীন সেই সার্কেলে যথাসময়ে এবং যথানিয়মে আয়কর রিটার্ন বা আয়কর বিবরণী দাখিল করবেন।
আইনের ধারা ২৬৪ (১১) অনুযায়ী সহযোগিতা চেয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, ধারা ২৬৪ (১১)-তে ‘ট্রেড বডি বা পেশাজীবী সংস্থার সদস্য পদ প্রাপ্তি ও বহাল রাখতে’ আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক (পিএসআর) উপস্থাপন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থ আইন, ২০২২ অনুযায়ী, ট্রেড বডি বা পেশাজীবী সংস্থার সদস্য পদ প্রাপ্তি বা বহাল রাখতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক (পিএসআর) দাখিলের আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
চিঠিতে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের সব চেম্বার হতে নেয়া তথ্য হতে প্রতীয়মান হয় যে, অনেক চেম্বারের তথা ট্রেড বডির সদস্যদের ই-টিআইএন নেই। যাদের ই-টিআইএন রয়েছে, তাদের অনেকেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না, যা আয়কর আইন, ২০২৩ এর সরাসরি লঙ্ঘন।
এনবিআর সূত্রমতে, অর্থ আইন, ২০২২-তে ট্রেড বডি বা পেশাজীবী সংস্থার সদস্য পদ প্রাপ্তি বা বহাল রাখার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক (পিএসআর) দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে এফবিসিসিআই থেকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সদস্যদের তালিকা নেয়া হয়। যার থেকে প্রতিটি সদস্যের ই-টিআইএন ও আয়কর রিটার্ন যাচাই করে এনবিআর। এতে দেখা গেছে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ই-টিআইএন নেই, রিটার্ন দাখিল করে না। সংগঠনের সদস্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশিরভাগের ই-টিআইএন নেই। অনেকের ই-টিআইএন থাকলেও রিটার্ন দেয় না। এফবিসিসিআই সদস্য হতে যে ই-টিআইএন দিয়েছে, তার বেশিরভাগ ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ই-টিআইএন। সদস্যভুক্ত কিছু ব্যবসায়ী রিটার্ন দাখিল করলেও আয়ের সঠিক হিসাব দেখানো হয় না। পুরাতন আয়কর আইনে কড়াকড়ি না থাকায় এসব ব্যবসায়ী ই-টিআইএন নিবন্ধন নেয়নি, রিটার্ন দাখিল করেনি।
অপরদিকে, এফবিসিসিআইকে উদ্দেশ্য করে চিঠিতে বলা হয়, আপনার সংগঠন, সংগঠনভুক্ত চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে এবং এসব সংগঠনভুক্ত সব সদস্যের ই-টিআইএন গ্রহণ, আয়কর রিটার্ন দাখিল ও দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন মোতাবেক আয়কর পরিশোধের জন্য অর্থাৎ আয়কর আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য জোর পরামর্শ প্রদান করা হলো। চিঠিতে সংগঠনভুক্ত এসব সদস্যকে উদ্দেশ করে বলা হয়, প্রত্যক্ষ কর’র মাধমে সরকার কেবল রাজস্বই আহরণ করে না। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করে দেশব্যাপী সবার অবদানের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সিঁড়ি অতিক্রম করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের এ প্রচেষ্টায় সক্ষম প্রতিটি করদাতারই উচিত প্রত্যক্ষ কর প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা।
এই বিষয়ে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নতুন করদাতা বাড়ানো, রিটার্ন দাখিল ও কর আদায় নিশ্চিত করতে নতুন আয়কর আইনে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ী সংগঠন ও তাদের সদস্যদের বিষয়ে এনবিআর হতাশ। কারণ, ৪৮৩টি সংগঠন (চেম্বার, সমিতি, অ্যাসোসিয়েশন)। ই-টিআইএন নেই, রিটার্ন দেয় না। অথচ প্রতিটি সংগঠনের নিজস্ব আয়, ব্যয় রয়েছে। রিটার্ন দেয় না। এসব সংগঠনের সদস্য ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগের ই-টিআইএন নেই, রিটার্ন দেয় না। সেজন্য প্রতিটি সংগঠনকে বিশেষ করে ব্যবসায়ী সংগঠনকে করের আওতায় আনা, সদস্যদের ই-টিআইএন ও রিটার্ন নিশ্চিত করতে নতুন আইনে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে এবং এনবিআরকে সহযোগিতা করতে আমরা এফবিসিসিআইকে চিঠি দিয়েছি। একই সঙ্গে এফবিসিসিআইভুক্ত সব সংগঠন, সেগুলোর সদস্যদের চিঠি দেয়া হয়েছে।’