মো. জিল্লুর রহমান: বর্তমান ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার অত্যন্ত উদ্বেগজনকহারে দ্রুত বাড়ছে; কিন্তু ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এগুলো যে পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ তৈরি করছে এবং এসব বর্জ্যরেও যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা ও সচেতনতা অত্যন্ত সীমিত। অত্যধিক জনঘনত্বের এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে, যা একদিকে যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে তা তেমনি পরিবেশ সুরক্ষার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং ই-বর্জ্য সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১৫ জুন ২০২১ প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ই-বর্জ্য থেকে কার্যকর ও বাধ্যতামূলকভাবে শিশুদের রক্ষা করতে আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ই-বর্জ্যরে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের রক্ষা করতে হলে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি বোঝায়। এগুলো মূলত ভোক্তার বাসাবাড়িতে ব্যবহƒত বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমনÑফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ প্রভৃতি। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে নিয়মনীতিহীন ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণ থেকে মানবস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পডতে পারে এবং পরিবেশ দূষণ হতে পারে। এসব যন্ত্রপাতিতে মানবস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অনেক ক্ষতিকর উপাদান থাকে। সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, লিড অক্সাইড প্রভৃতি ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, যকৃৎ, বৃক্ক, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, ত্বক প্রভৃতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
এসব ই-বর্জ্যরে মধ্যে সিসা, সিলিকন, টিন, ক্যাডমিয়াম, পারদ, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি রাসায়নিক থাকে এবং এসব রাসায়নিক দেশের মাটি ও পানিকে দূষিত করছে। মাটির গুণগত মান বিনষ্ট করছে, শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। নানাভাবে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ঝুঁকি বেশি। ই-বর্জ্যরে সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। শিশু বড় হলে ফুসফুস, শ্বাসতন্ত্র, থাইরয়েড জটিলতা, ক্যানসার এবং হƒদরোগের মতো বড় রোগের জটিলতাও পড়ে। তাই ই-বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে বছরে কী পরিমাণে ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, ধ্বংস হয় ও পরিবেশে মিশে যায়, তা নিয়ে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল এবং এতে বলা হয়, ওই বছর দেশে ৪ লাখ টন বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিক (ইলেকট্রনিকস) বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে কেবল তিন শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিংশিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় ভাগাড়ে। এতে আরও বলা হয়, দেশে প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ এই ই-বর্জ্য বছরে ৪৬ লাখ টনে দাঁড়াবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য মতে, ‘২০১৬ সালে ১ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন ই-বর্জ্য বের হয়েছে। ২০২১ সালের ১ হাজার ১৬৯.৯৮ টন মোবাইল ই-বর্জ্য বের হবে।’
ই-বর্জ্যরে এই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে তিন দশক আগে যখন কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস পণ্য ও মোবাইল ফোনের উন্নতি ও বিস্তার শুরু হয়। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি ১০ জুন ২০২১ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের একটি বিধিমালাটির গেজেট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এখানে মানুষ কিছুদিন পরপরই টেলিভিশন, স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বদলায়। সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় পুরোনো বেশিরভাগ সরঞ্জাম পুনর্ব্যবহার হয় না। উল্টো তা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যে নানাভাবে ক্ষতি করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধিমালাটিতে ই-বর্জ্যরে ঝুঁকি কমাতে কী করা উচিত, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাজের বণ্টন, ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অভিভাবক কারা, আমদানি করা বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিক পণ্যের পরীক্ষা, পরীক্ষাগার-সংক্রান্ত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কী করা উচিত, তা উল্লেখ নেই। এছাড়া ই-বর্জ্য পরিবহন, ধ্বংসে নিযুক্তদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো নীতিমালার বাইরে রয়ে গেছে।
ই-বর্জ্য শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই বড় উদ্বেগের কারণ; এগুলো একদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ করছে। ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট স্ট্যাটিসটিকস পার্টনারশিপের (জিইএসপি) এক হিসাব বলছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ই-বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ে। ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে ৫ হাজার ৩৬০ কোটি কেজি ই-বর্জ্য জমা হয়। সে বছর মোট উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে শুধু ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। ই-বর্জ্য বেশি জমা হচ্ছে নি¤œ আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
২০১৪ সালে জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় বিশ্বে প্রতি বছর ৪ কোটি টনেরও বেশি ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনÑকেবল এই দুটি দেশই সারাবিশ্বের ই-বর্জ্যরে এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি এশিয়ার ই-বর্জ্য নিয়ে অন্য একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এশিয়ায় ই-বর্জ্যরে পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। ১২টি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে তারা বলছে, এই পাঁচ বছরে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন। এদের মধ্যে চীনের অবস্থা ভয়াবহ। এ সময় তাদের দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখ ৮১ হাজার টন; যা পুরো এশিয়ার জন্য উদ্বেগের বলে বলা হচ্ছে। যদিও এসব ই-বর্জ্যে অনেক অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু ও অন্যান্য উপাদান মিশে আছে, যেগুলো পুনঃচক্রায়ন করা সম্ভব। লোহা, তামা, সোনা, রুপা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়াম ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য উপাদানগুলোর মোট মূল্য ৫ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন এর পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থাপনা ও নীতিমালা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। এসব নারীও তাদের অনাগত সন্তানদের বিষাক্ত ই-বর্জ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরের একটা বড় অংশের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, যারা সক্রিয়ভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত আছে। সংস্থাটি আরও বলছে, অভিভাবকরা প্রায়ই শিশুদের ই-বর্জ্য খেলতে দেন ও পুনর্ব্যবহার কাজে লাগান। ঘরের মধ্যে শিশুরা এগুলো খেলনা হিসেবে ব্যবহার করে। ই-বর্জ্যরে বিষাক্ত রাসায়নিক, বিশেষ করে মার্কারি এবং সিসা উচ্চমাত্রায় থাকে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ খুব সহজেই শিশুর শরীরে প্রবেশ করে এবং এতে শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের ক্ষমতা হ্রাস পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, যন্ত্র ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি শেখা। এতে মোবাইল, ল্যাপটপ ও ট্যাব বেশি দিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে পুরোনো সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানোর ওপরে। একই যন্ত্র একাধিক কাজ করবে, এমন মাল্টিপারপাস ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। একই চার্জারে সব সংস্থার সব মডেলের মোবাইল চার্জ করা যায়, এমন চার্জারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্মের ব্যবহার, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কিছুটা সুফল মিলবে। তাছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের সমস্যা ও হুমকি হয়ে উঠছে; যা সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ই-বর্জ্যের কারণে ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এটা বিশ্বব্যাপীই ঘটছে। এর জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ই-বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ নিরূপণের ব্যবস্থা; তারপর এগুলোর জন্য স্থায়ী ভাগাড় ও রিসাইক্লিং কারখানা স্থাপন করা। জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগও নিতে হবে। এ বিষয়ে ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি উৎপাদন, আমদানি, বিপণন, ব্যবহার এবং ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নীতিমালা ও আইন-বিধান মেনে চলার ব্যবস্থা ও তদারকি করা। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে প্রায় ১৩ কোটি মানুষের হাতে মুঠোফোন; অন্যান্য ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। এগুলোর প্রায় ৩০ শতাংশই প্রতি বছর ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন বিক্রয়কারী সংস্থাও ব্যবহৃত পুরোনো সামগ্রী সংগ্রহ করে তা রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করছে। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং রক্ষা করতে হবে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ।
ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক
rbbbp@gmail.com