নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈদুল আজহার আগে-পরে ১২ দিনে (৫ থেকে ১৬ জুলাই) দেশে ২৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ হাজার ১৯৭ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৪৩, শিশু ৫৮। দুর্ঘটনার ২৭ শতাংশের বেশি হয়েছে ভোর ও সকালে। দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এ তথ্য তুলে ধরেছে। নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ফাউন্ডেশন। গতকাল বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন দেয় ফাউন্ডেশন।
প্রতিবেদনে গত চার বছরের ঈদুল আজহার যাত্রাকালের দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরা হয়। সে অনুযায়ী, এ বছর দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে ঈদযাত্রার সময় ১৪৬ দুর্ঘটনায় ১৯৭ জন নিহত হন। পরের দুই বছরে নিহতের সংখ্যা ছিল ২২৯ ও ২০৭।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে এখন নিত্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে।’’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবার ঈদযাত্রায় ১৫৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১২৩ জন, যা মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৪৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৩ জন, অর্থাৎ ১৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এই সময় ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন ও ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১৪টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১২৩ জন (৩৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ), বাসযাত্রী ৩৩ জন (১০ দশমিক ৬১), ট্রাক-পিকআপ-লরি আরোহী ১৬ জন (৫ দশমিক ১৪ শতাংশ) বাস-প্রাইভেট কার যাত্রী ১৮ জন (৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ), থ্রি হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজিচালিত অটোরিকশা-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ৫৭ জন (১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-আলমসাধু-টমটম-মাহিন্দ্রা-পাওয়ারটিলার) ১০ জন (৩ দশমিক ২১) ও বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা আরোহী ৮ জন (২ দশমিক ৫৭ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১০৯টি জাতীয় মহাসড়কে, ৭৭টি আঞ্চলিক সড়কে, ৬১টি গ্রামীণ সড়কে ও ২৭টি শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাগুলোর ৭৬টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৯৯টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৫১টি পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেয়া, ৪২টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা ও ৬টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৩৪ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছর এবং নিহত পথচারীদের ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন।
২০২১ সালের ঈদুল আজহা উদযাপনকালে ৮৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৫ জন নিহত হন। এই হিসাবে এ বছর ঈদুল আজহায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৮৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ৪ দশমিক ৭৪, সকালে ২২ দশমিক ৬২, দুপুরে ১৯ দশমিক ৭০, বিকালে ২০ দশমিক ৮০, সন্ধ্যায় ৯ দশমিক ৮৫ দশমিক ও রাতে ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ আর প্রাণহানি ৩৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ ও প্রাণহানি ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে। আর এ বিভাগে প্রাণহানি ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বরিশালে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৪৭ ও প্রাণহানি ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪ দশমিক ৭৪ ও প্রাণহানি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। রংপুরে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৯৩ ও প্রাণহানি ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ১০ ও প্রাণহানি ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এবারের ঈদুল আজহা উদ?যাপনকালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনা ফিরতি যাত্রায় বেশি হয়েছে। গত বছরের ঈদুল আজহার চেয়ে এ বছরের ঈদুল আজহায় দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা রোধে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।