Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 12:44 pm

ঈদ আয়োজনে ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা

আরফাতুর রহমান শাওন: ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আরও বেশ কিছু ধর্মীয় উৎসব থাকলেও বছরে দুটি ঈদ বয়ে আনে বিশেষ কিছু, বিশেষ আনন্দ। সারা বছর ধরে বিশ্বের সব মুসলিম জাতি অপেক্ষায় থাকে ঈদ উৎসবের। প্রস্তুতি চলে বছরজুড়ে। এর মধ্যে বাঙালির ঈদ একটু হলেও ব্যতিক্রম। এ উৎসব শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি যোগ দেয় এই উৎসব আনন্দে। এই বৈশিষ্ট্যই বাঙালির ঈদকে মহিমান্বিত করে তোলে।

ইতিহাস বলছে, নবাবি আমলে ঢাকায় ঢোল পিটিয়ে ঈদের ঘোষণা করা হতো। রাজপথ পদদলিত হতো ঈদের মিছিলে। বিভিন্ন স্থানে মেলা, রেসকোর্সে  ঘোড়দৌড় আর মুখরোচক খাবারের গন্ধে  ম-ম করত চারপাশ।

অতীতের মতো জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ আয়োজন আর চোখে পড়ে না। অনেকেই বলেন, এ যুগে ঢাকার ঈদ পানসে। চোখ ধাঁধানো, মন জুড়ানো সেই সব আয়োজন এখন আর দেখা যায় না। নগরায়ণের কুঠারাঘাতে কমেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ। ঈদ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ব্যক্তি ও পরিবারের মাঝে।

তবে ঈদ আয়োজনের কিছু ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। প্রতি বছরের মতো ঢাকাবাসী ঈদের ৭ দিন পর্যন্ত ঈদের আনন্দ চলমান থাকে। এমনিতেই বিগত প্রায় আড়াই বছর ধরে  কভিড-১৯ এর কারণে ঈদের আনন্দে অনেকটা ভাটা পড়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাসী বলা যায় ঈদের আনন্দ পুরোপুরি গৃহবন্দি অবস্থায় ঈদ পালন করেছে। তবে শিশুরা অনেকটা বিনোদনমুখী হতে পারছিল না। তাদের মানুষিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট।

২০২২ সালের ঈদুল ফিতর শিশুদের আনন্দের চাহিদা পুরোপরি পূরণ করেছে বলা যেতেই পারে। প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন ঈদ আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। এরই ব্যতিক্রম হিসেবে ঢাকা শহরের ঐতিহ্যবাহী বংশালে আয়োজন ছিল সেরাদের থেকেও সেরা। এমনিতেই বিভিন্ন ঐতিহ্যের দিক থেকে পুরান ঢাকার বংশাল অনেকটা এগিয়ে। তার ওপর এই বছর ঈদ আয়োজনে কোনো দিক থেকে কমতি রাখেননি আয়োজকেরা। তবে এবারের ঈদে মহামারিমুক্ত পরিবেশে জমে উঠেছে পুরান ঢাকার উৎসব।

এবার পুরো বংশাল এলাকাটি আলোকসজ্জা দিয়ে সজ্জিত করা হয়। ঐতিহ্যবাহী বংশাল পুকুরপাড়ের রাতের দৃশ্য আলোর ফোয়ারায় দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। তার সঙ্গে পুকুরের নৌকা ভ্রমণের সুব্যবস্থা করা হয়েছিল।  নৌকাগুলোর সাজসজ্জায় ছিল মোগল রাজকীয়তার ছাপ। শিশু-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধরা পর্যন্ত নৌকা ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করেন। শিশুদের বিনোদনের সার্বিক আয়োজনে এক বিশাল মিলনমেলায় মন চায় যেন শিশুদের মতো আবারও ফিরে যেতে চাই ঈদের দিনের স্বপ্নিল শৈশবে। তাই তো কবির সুরে বলতে হয় বাঁধভাঙা ঈদের আনন্দে হারিয়ে যেতে নেই মানা।

আরেকটি আয়োজন ছিল অতুলনীয় সেটি হচ্ছে ‘মেলা’। ঐতিহ্যগত দিক থেকে সবাই মেলা পছন্দ করে। বংশাল মেলার নাম দেয়া হয়েছে ‘ঈদ আনন্দ মিনি  মেলা’। মেলা আয়োজন করেছেন বংশালেরই কৃতী সন্তান ৩৫নং ওয়ার্ড বংশাল থানা, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মিল্লাত উচ্চবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এস আই ফারিয়াদ। তারই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মেলাটি  সেরাদের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে এ যাবৎ কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মেলার খেতাবও পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকায় বিনোদনের তেমন জায়গা নেই। সে জন্য ঈদে যেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা কিছুটা হলেও বিনোদনের পায় তাই এই মেলা করা। এখানে যে রাইডগুলো আছে অন্য যেকোনো জায়গা থেকে কম টাকায়। এখানের আগত সর্বস্তরের জনসাধারণ যেন  সেগুলো উপভোগ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আবহমান গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে নতুন প্রজšে§র কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তবে সামনের ঈদগুলোতে আরও সুন্দরভাবে মেলার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।

মেলার আয়োজক কমিটি অন্যতম মো. আলী মলি বলেন, নয়াবাজার ফ্রেঞ্চ  রোড একটি ব্যস্তময় একটি রাস্তা। সচরাচর এখানে যানবাহন ও  লোকারণে ভিড় লেগেই থাকে। গ্রামে লোকজন চলে যাওয়ায় রাস্তাটি ফাঁকা হয়ে পড়েছে। মহামারির কারণে শিশুরা সে রকম বিনোদন করতে পারছিল না। তাই আমরা ঢাকাবাসীকে আনন্দ উপহার দেয়ার জন্য মেলাটির আয়োজন করি।

মেলার আয়োজক কমিটি রাব্বী রহমান রনো জানান, ‘মেলায় শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্য বিভিন্ন রাইড আছে। এখানে সান্তা মারিয়া নৌকা, নাগরদোলা, ইলেকট্রিক হর্স রাইড, চরকি, ট্রেন, ঘোড়া গাড়ি, জাম্পিং প্যাড, ফোর হর্স রাইড, পুতুল নাচ, ঐতিহ্যবাহী  নৌকা ভ্রমণ ও খেলনার বিভিন্ন পশরাসহ খাবারের স্টল আছে। এছাড়া আতশবাজি, সারফি  লেজার, আকর্ষণীয় লেজার আলোকসজ্জা রয়েছে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ বাড়াতে।

মেলার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর শিশুরা সেভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারিনি। এবার তাদের উপস্থিতি বড়দেরও উৎসাহিত করেছে। তাদের পদচরণায় মেলা মুখর। পুরান ঢাকাবাসী বিনোদন কেন্দ্রের অনেক অভাব। আয়োজকরা চেষ্টা করেছেন দর্শনার্থীরা যেন তাদের পরিবারের সঙ্গে  মেলায় আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। বংশাল পুকুর পাড় শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে। তাই আমরা পুকুরে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেন শিশুরা বাংলার প্রকৃতির দৃশ্য কিছুটা হলেও উপভোগ করতে পারে।

স্থানীয় কয়েকজন নাগরিক বলছেন, কর্মব্যস্ত নগর জীবন এ মেলা আমাদের গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে। আমরা চাই প্রতি বছর   এ মেলা অনুষ্ঠিত হোক।

শিক্ষক

মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়

বংশাল, ঢাকা