Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 9:57 pm

ঈদ সামনে রেখে কর্মচঞ্চল সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লি

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ : বৈশাখ ও ঈদকে সামনে নিয়ে তাঁত বুননের খট-খট শব্দে আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লিগুলো। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁতের মাকুর আকার-টাকুর শব্দে মুখর জেলার তাঁতপল্লিগুলো এখন কর্মমুখর।

কারিগরের দিন-রাত পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে বেনারসি, সিল্ক, রেশমি, কটন, জামদানি ও কাতান শাড়ি। নিপুণ হাতে আধুনিক ও শৈল্পিক কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে বাহারি নকশা। একই সঙ্গে বৈশাখের আবহে শাড়িতে ঢাক-ঢোল, একতারা-দোতারা, কলসি, ঘুড়ি, নৌকা, হাতপাখা, মাছ ধরার পলো প্রভৃতি ছবি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।

গতকাল বুধবার সকালে সরেজমিনে গেলে তাঁত মালিকেরা বলেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারজাত করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে তুলনা করে বাজারজাত করতে পারছেন না। রং ও সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে জেলার ঐতিহ্যবাহী এই তাঁতশিল্প।

জানা যায়, সরকারিভাবে এ জেলা পরিচিত তাঁতকুঞ্জ হিসেবে। জেলায় তাঁতের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও পূজা-পার্বণে তাঁতের কাপড়ের চাহিদা বাড়ে। তাঁতপল্লিতে কাজের চাপ বেড়ে যায় দ্বিগুণ, রাতদিন দম ফেলার সময় থাকে না শ্রমিকদের। আর তাই এ বছর পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে সামনে রেখে কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁত বুননের খটখট শব্দে মুখর এখন  তাঁতপল্লি। জেলার তাঁতপ্রধান এলাকা-খ্যাত বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালী, এনায়েতপুর ও সদর উপজেলার প্রতিটি তাঁতপল্লিতে মালিক-শ্রমিক মিলিত হয়ে কাজ করছেন। সেইসঙ্গে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও বেড়েছে। তৈরি হচ্ছে বাহারি নামের আর নতুন নতুন ডিজাইনের আধুনিক মানের জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, বেনারসি ও বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি। কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতিরা। শৈল্পিক কারুকার্যে তাঁতবস্ত্রকে বাজারজাত করা হচ্ছে। কিন্তু ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হলেও জেলার তাঁতপল্লিগুলো আবারও কর্মমুখর হয়ে ওঠায় খুশি তাঁত শ্রমিকরা।

কাপড় ব্যবসায়ী সূত্রে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা, শুভরাজ, গঙ্গারামপুর ও পাটনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় শহরের শোরুমের মালিক ও পাইকাররা এখানে শাড়ি কিনতে আসছেন। তবে করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন লোকসানের মুখে থাকা এ শিল্পটি আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠায় আশার কথা বলছেন তারা।

তাঁত শ্রমিক ইসলাম হোসেন, শফিকুল ও মোহাম্মদ আলীসহ কয়েকজন বলেন, আমাদের মজুরি কম, বৈশাখ ও ঈদ উপলক্ষেও কোনো বোনাস নেই। কাজ করলে মালিকরা টাকা দেন, না করলে দেন না। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করি। রমজান মাসে খরচ একটু বেশি হচ্ছে। তাই একটু বেশিই পরিশ্রম করছি। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো নেই। কোনো রকমে বেঁচে আছি।

বৈশাখের শাড়ি ও তাঁত ব্যবসায়ী ফিরোজ উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক হাজি ফিরোজ হাসান ও হাজী ফারুক হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বলেন, মার্চ মাসের শুরু থেকে পহেলা বৈশাখের আগের রাত পর্যন্ত চলে প্রিন্টিংয়ের কাজ। ঢাকার গাউছিয়া, ইসলামপুর, টাঙ্গাইলের করটিয়া, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পাবনার আতাইকুলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কারখানা থেকে শাড়ি নিয়ে যান। বর্তমানে বাজারে বৈশাখী শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন লোকসানের মুখে থাকায় পুঁজি সংকটে পড়েছেন অধিকাংশ তাঁত মালিক। ঈদ উপলক্ষে নতুন করে শুরু করলেও রং-সুতাসহ সব উপকরণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের কক্সিক্ষত দাম পাচ্ছেন না তারা।

পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমএ বাকী বললেন, জেলায় তাঁতশিল্পে পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। আর এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সরকার কৃষি উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু বস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শিল্পের জন্য ভর্তুকির কোনো ব্যবস্থা নেই। দেশের আর্থিক খাতের জোগানদাতা বস্ত্র খাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকলে তাঁতশিল্পকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। এজন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন তারা।

সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক একরামুল হক রিজভী বলেন, সিরাজগঞ্জের অর্থনীতি তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাই দেশীয় তাঁতশিল্প রক্ষায় সরকারকে তাঁতিদের ঋণসহ রং ও সুতায় ভর্তুকি দিতে হবে। পাশাপাশি অবৈধপথে ভারত থেকে কম দামি শাড়ি আসা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ হবে।