ঈশ্বরতুল্য ভাবমূর্তি

শামসুন নাহার: আম্বানির মতো নুসলি ওয়াদিয়াকেও ছোটখাটো মামলায় জড়িয়ে পড়তে হলো। তার মধ্যে কলকাতার হাইকোর্টে কামাল সিং বংশালীর মামলাটি বেশ জটিল। বোম্বে ডায়িংয়ের মাত্র পাঁচটি শেয়ার কিনেছিলেন বংশালী। তার অভিযোগ ছিল, তার শেয়ার ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ভুলভাবে দাখিল করা হয়েছে। এ মামলায় বোম্বে ডায়িংয়ের শেয়ার ডিভিডেন্ড বণ্টনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। অথচ এ আদেশের মাত্র দু’দিন পরেই বোম্বে ডায়িংয়ের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) ডিভিডেন্ড ঘোষণার কথা ছিল। বংশালীর শেয়ারের মূল্য তখন মাত্র দুই হাজার ৬০০ রুপির কাছাকাছি। অথচ এ মামলায় তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন ভারতের সবচেয়ে খ্যাতনামা আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠানকে।  এ প্রতিষ্ঠানের আইনজীবীদের যে পরিমাণ অর্থ পারিশ্রমিক দিতে হয়েছে, তা তার শেয়ারদরের চেয়ে অন্তত ১০০ গুণ বেশি।

সেদিক থেকে ধীরুভাই এ ধরনের বিপত্তিকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছেন। একের পর এক মামলা ও কেবিনেটের উদ্দেশ্য প্রণোদিত সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও যথারীতি এজিএমের আয়োজন করা হলো। এবার এতই জাঁকজমকপূর্ণ এজিএমের ব্যবস্থা করল রিলায়ান্স যে, এমনকি কো-অপারেজ ফুটবল স্টেডিয়ামেও স্থান সংকুলান হলো না। ৩৫ হাজার বিনিয়োগকারী সমবেত হলেন মুম্বাইয়ের ক্রস মেইডেন পার্কে। এত লোকের সমাগম হওয়ার বিশেষ কারণ ছিল বটে। তারা নিজের চোখে দেখতে চান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আঘাত ও ফেব্রুয়ারিতে স্ট্রোক করার পর কীভাবে সামলে নিচ্ছেন আম্বানি। পত্রিকার এত অভিযোগের কী জবাবই বা আছে তার কাছে। পাশাপাশি তাদের মনে এ বিশ্বাসও নিশ্চয়ই ছিল যে, মঞ্চে দাঁড়ানো লোকটি ধীরুভাই আম্বানি। তিনি যেভাবেই হোক, সরকার ঘোষিত কনভারসন ব্যানের ব্যাপারে একটা উপযুক্ত সমাধান নিয়ে হাজির হবেন।

বিনিয়োগকারীদের নিরাশ করেননি ধীরুভাই। স্ট্রোকের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠলেও তার ডান হাত অবশ হয়ে আছে। কথা বলতেও কিছুটা কষ্ট হয়। তবু শক্তি সঞ্চয় করে উপস্থিত জনতাকে জানালেন, শিগগিরই রিলায়ান্স সম্পূর্ণ রূপান্তরযোগ্য ডিবেঞ্চার ইস্যু করতে যাচ্ছে। এ ইস্যুতে অগ্রাধিকার পাবেন বর্তমান শেয়ার ও ডিবেঞ্চার হোল্ডাররা। এছাড়া ই ও এফ সিরিজের ডিবেঞ্চারের কনভারসন অর্ডার পেতেও লড়াই চালিয়ে যাবে রিলায়ান্স। ওদিকে সেল রিপোর্টেও এগিয়ে কোম্পানিটি। গত বছরের তুলনায় বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অন্তত ৪২ শতাংশ বেশি সেল হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলেও এ বছর শেষে এক হাজার কোটি রুপি আয় করবে রিলায়ান্স।

আম্বানির আরেক নাম যেন চমক। এত বড় আঘাত সামলেও নিজের ব্যবসাকে ঠিকই সামলে নিচ্ছে। সবাইকে টপকে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের চোখে আম্বানি যেন দেবতার সমান শক্তিধর। মন্ত্রমুগ্ধ জনতার বিস্ময় যখন তুঙ্গে আম্বানি তখন ঘোষণা দিলেন তার পরবর্তী পরিকল্পনার। বললেন, নতুন ও চলতি প্রজেক্টসহ গুজরাটের হাজিরাতে প্রস্তাবিত পেট্রোকেমিক্যাল প্লান্টে প্লাস্টিক উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হবে আরও দুই হাজার কোটি রুপি। পাতালগঙ্গার প্লান্টের মতোই এটিও একটি সফল প্রজেক্ট হতে যাচ্ছে। রিলায়ান্সের প্লান্টে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের মনে ঈর্ষার জš§ দিয়েছে। অনেক মহল আমাদের পেছনে টেনে ধরতে চাচ্ছে। বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে গতি রোধ করতে চাচ্ছে। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নি। কারণ রিলায়ান্সের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। সম্প্রতি আরও তিন লাখ ২০ হাজার শেয়ারহোল্ডার রিলায়ান্স পরিবারের যোগ দিয়েছে। এখন বিরাট এ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৮ লাখ। আইনের বাইরে কাজ করেনি রিলায়ান্স। এফ সিরিজের একটি ডিবেঞ্চারও ম্যানেজমেন্টের কেউ নিজের জন্য রাখেনি। ৫৫টি দেশের ১১ হাজার প্রবাসী ভারতীয় এ ডিবেঞ্চার কিনেছে। এটা ভারত না হয়ে অন্য কোনো দেশ হলে এ সফলতার জন্য কোম্পানিকে পুরস্কৃত করা হতো। অথচ আমাদের ভাগ্যে জুটেছে অপবাদ, মামলা।

আম্বানির এ বক্তৃতায় রিলায়ান্সের বিনিয়োগকারীরা আশা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাদের কাছে আম্বানি তার ঈশ্বরতুল্য ভাবমূর্তিও ধরে রাখতে পেরেছিলেন হয়তো। কিন্তু কাগজের পাতায় তার বিরুদ্ধে বিষ ছড়ানো অব্যাহতও ছিল। এর মধ্যে মুকেশ গেলেন গোয়েঙ্কার কাছে নিউজ বন্ধ করার অনুরোধ নিয়ে। পরে আম্বানিও গেলেন। সাময়িকভাবে ‘রিলায়ান্স সিরিজ’ বন্ধও হলো। কিন্তু রোষের আগুন আবারও জ্বলে উঠল যখন কংগ্রেসপন্থি ম্যাগাজিন ‘অনলুকার’ ওয়াদিয়ার বিরুদ্ধে লেখা শুরু করল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাদে আরও কয়েকটি পত্রিকা রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে যাওয়াকেই বেছে নেয়। সাপ্তাহিক ব্লিটস্্ লিখল, রাষ্ট্রায়ত্ত কানারা ব্যাংকের বোম্বে শাখায় হাতে লেখা সংশোধনীর মাধ্যমে ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার তারল্য বৃদ্ধি করা হয় ১৯৮৫ সালের ২৯ মে-তে, যেদিন কি না ইমপোর্ট পলিসি পরিবর্তন করা হয়েছিল। ওই সংশোধনীর কপি ছাড়াও কানারা ব্যাংকের উদ্দেশ্যে রিলায়ান্সের একজন ফিন্যান্স ম্যানেজারের লেখা ৩১ মে তারিখের একটি চিঠির কপি রয়েছে ব্লিটসের হাতে। এ চিঠিতে বলা হয়েছে, সাপ্লায়ারের (ব্রিটিশ কেমিক্যাল জায়ান্ট আইসিআই) সঙ্গে ব্যাংকের যোগাযোগের মাধ্যমে যে এলসি খোলা হয়েছে তাতে তারিখের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়নি। আপনাকে অনুরোধ করা যাচ্ছে, সাপ্লায়ারের সঙ্গে যোগাযোগের সময় গুরুত্ব সহকারে জানিয়ে দেবেন যে, ২৮ মে ১৯৮৫ থেকে এলসি কার্যকর করা শুরু হয়েছে। কানারা ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারও ভালো মানুষের মতো আইসিআইকে টেলেক্স করে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন।

এ ধরনের আরও কয়েকটি এলসির তথ্য উপস্থাপন করে ব্লিটস প্রমাণ করতে চেয়েছে, আমদানি নীতিমালা পরিবর্তনের সময় গ্রেস পিরিয়ড পাওয়ার জন্য এলসি কার্যকরের তারিখ পরিবর্তন করে ২৯ মের আগে বদলে নিয়েছে রিলায়ান্স।

গুরুমূর্তির ‘লোন মেলা’ অভিযোগের পর ব্লিটসের ‘কানারা ব্যাংক’ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে গুরুমূর্তির যুক্তিই যেন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। কারণ গুরুমূর্তির লোন মেলা রিপোর্টে কানারা ব্যাংকের অনেকগুলো শাখার সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ শুরুতে এ ধরনের পরিবর্তনে আপত্তি তুললেও পরে রাজি হয়েছিল। ওদিকে জুলাইয়ের শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে জানায়, ১৯৮৫ সালে নয়টি ব্যাংক রিলায়ান্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কোম্পানিকে রিলায়ান্সের শেয়ার ও ডিবেঞ্চারের বিপরীতে মোট ৫৯ কোটি ২৮ লাখ রুপি অ্যাডভান্স দিয়েছে। মোট ৬৩ কোম্পানির জন্য ১৮৭টি ঋণ হিসাব খোলা হয়। ওই ৯টি ব্যাংকের মাধ্যমে রিলায়ান্স মোট ৯১ কোটি ৯০ লাখ রুপি আমানত রাখে। ঋণগ্রহীতা কোম্পানির মধ্যে বেশ কয়েকটিই অল্পদিন আগেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কোম্পানির মূলধন ছিল মাত্র এক হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। এত অল্প মূলধনের কোম্পানি ৯৫ লাখ রুপির ঋণ কীভাবে নেয়Ñতাও এক চিন্তার বিষয় বটে। ঋণের উদ্দেশ্য হিসেবে চলতি মূলধন বা শেয়ার কেনাকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সব ক্ষেত্রেই ঋণের সিকিউরিটি হিসেবে দেখানো হয়েছে রিলায়ান্সের শেয়ার বা ডিবেঞ্চারকে।

অর্থমন্ত্রী সিং ১৪ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট পাওয়ার পর তা সংসদের নি¤œকক্ষে পাঠালেন। ওদিকে গভর্নর আরএন মালহোত্রা তার ডেপুটি সি. রঙ্গরাজন ও আরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার দায়িত্ব দিলেন। ২২ জুলাই সিং সংসদের উচ্চকক্ষে এমপিদের আশ্বস্ত করে বললেন যে, যদি রঙ্গরতন কমিটি কোনো প্রকার আইনভঙ্গের প্রমাণ পায় তবে এসব ঋণ বাতিল করা হবে। এ মন্তব্যের ফলে দালাল স্ট্রিটে আরেক দফা বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। রিলায়ান্সের শেয়ারের মূল্য কমে ৩৬৬ রুপি থেকে ৩১২ রুপিতে নেমে এলো।

রিলায়ান্সের বিপদ তখনও কিছু বাকি ছিল। আরেক নতুন আঘাত নেমে এলো যখন এক দল বিরোধীদলীয় নেতা রিলায়ান্সের ওপর পূর্ণাঙ্গ আইনি তদন্তের দাবি করলেন। এ দলে ছিল কমিউনিস্ট, বিজেপি ও বিভিন্ন আঞ্চলিক পার্টির নেতারা। একটি একচেটিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে পত্রিকার রিপোর্ট কী পরিমাণ রোষ তৈরি করতে পারেÑএকের পর এক স্কিম ফাঁস করে, তাই প্রমাণ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে ভারতের সংসদে যে সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ গর্জে উঠেছে, তাতে এ পর্যায়ে কোণঠাসা হয়েছেন আম্বানি। কোম্পানির ব্যালান্সশিট যতই সাফল্যমণ্ডিত দেখাক না কেন, আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আম্বানির। আর এ পরিস্থিতিই মূলত পাল্টা আঘাত হানার উপযুক্ত সময়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০