নজরুল ইসলাম: রাজধানীর দনিয়া এলাকায় চারতলা বাড়ি। চাঁদপুরে স্ত্রীর নামে জমি। স্ত্রীর নামে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার ১৩৯ টাকার সম্পদ। এ ছাড়া ২২ লাখ ১৭ হাজার ৫৭১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন। এসব করেছেন সিটি করপোরেশনের একজন উচ্চমান সহকারী। তার নাম জাকির হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, দুর্নীতির টাকায় তিনি এসব সম্পদ অর্জন করেছেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। দুদকের উপসহকারী পরিচালক এসএম আনিসুজ্জামান এটি দাখিল করেছেন।
চার্জশিট সূত্রে জানা গেছে, জাকির হোসেন ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ঢাদসিক) থেকে অবসরে গেছেন। তিনি ১৯৮৭ সালের ১৪ অক্টোবর নি¤œমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি পান। ২০০৯ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিবের ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক হিসেবে করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে (অঞ্চল-৫, সায়েদাবাদ) কর্মরত ছিলেন।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, জাকির হোসেন মৌজায় ১৯৯৭ সালে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় ৩ দশমিক ১৯ কাঠা জমি কিনেছেন। ২০০১ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে সেই জমিতে ছয়তলা ভিতের ওপর চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছে। বাড়ি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে চাঁদপুর সদরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব জাফরাবাদ গ্রামে ছয় লাখ টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে ২০ শতাংশ নাল জমি কিনেছেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। যে বেতন-ভাতাদি পেয়েছেন, তা দিয়ে চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণ ও সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহনের পর কোনো টাকা অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনে চাকরির সুবাদে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এসব অর্জন করেছেন।
তিনি ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে নিজ নামে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদের ঘোষণা দেন। সম্পদ বিবরণী যাচাই ও মামলা তদন্তকালে তার নিজ নামে ও তার ওপর নির্ভরশীল গৃহিণী স্ত্রী রোকেয়া হোসেনের নামে ৮৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর ও পাঁচ লাখ লাখ হাজার ৫৭১ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৮৯ লাখ ৬৭ হাজার ৫৭১ টাকা মূল্যের সম্পদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিনি ২২ লাখ ১৭ হাজার ৫৭১ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপনের মাধ্যমে মিথ্যা বিবরণী দাখিল করেছেন, যা দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সম্পদ অর্জনের আয়ের উৎস হিসেবে তিনি জানান, তার নামে বাড়ি নির্মাণের টাকা তার ব্যবসায়ী ছোট ভাই আক্তার হোসেন দিয়েছেন। তার বিনিময়ে বাড়িটি তার ছোট ভাইকে দিয়েছেন। এ বাড়িটি তার নয়। তদন্তকালে এ বিষয়ে তার ছোট ভাই লিখিত বক্তব্যে জানান, তার বড় ভাই জাকির হোসেনকে বাড়ি নির্মাণের সময় ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ঋণ দেন। ঋণের বিষয়ে ২০০৭ সালে তার আয়কর নথিতে ২৫ লাখ টাকার ঘোষণা দেন। জাকির হোসেন ২০০৯ সালে সেই টাকা ফেরত দিয়েছেন। অবশিষ্ট ১৫ লাখ টাকা আয়কর নথিতে ঘোষণা দেননি, ফেরতও নেননি। সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে আক্তার হোসেনের আয়কর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, আক্তার হোসেন তার ভাই জাকির হোসেনকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার বিষয়টি ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ করবর্ষের আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেছেন। পরে ২০০৯-১০ করবর্ষের রিটার্নে তা আর দেখানো হয়নি। অর্থাৎ এ সময়ে তিনি ২৫ লাখ টাকা জাকির হোসেনের কাছ থেকে ফেরত পেয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া ১৫ লাখ টাকা জাকির হোসেনকে দেয়ার বিষয়টি আক্তার হোসেনের আয়কর নথিতে উল্লেখ নেই। কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
মামলা তদন্তকালে জাকির হোসেনের নামে আয়কর নথি পাওয়া যায়নি বলে তার আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে তার চাকরির বেতন-ভাতা ছাড়া আর কোনো আয়ের উৎস পাওয়া যায়নি। ঢাকা সিটি করপোরেশনে যোগদান থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে প্রাপ্ত বেতন-ভাতাদির তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, তিনি এ সময়ে বেতন-ভাতাদি বাবদ মোট ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬৩ টাকা পেয়েছেন। তারপরও বেতন-ভাতা বাবদ প্রাপ্ত টাকা থেকে ৫০ শতাংশ পারিবারিক ব্যয় বাদ দিয়ে সঞ্চয় ধরা হয়েছে ২২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩১ টাকা। ব্যয় ও অর্জিত নিট সম্পদ একত্রে দাঁড়ায় এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। অপরদিকে তার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে নেয়া ঋণসহ মোট আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৭০ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬৩ টাকা। এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে অর্জিত সম্পদ ও ব্যয় বেশি পাওয়া গেছে।
ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ বাবদ ব্যয়সহ মোট ব্যয় পাওয়া গেছে ৪৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬২ টাকা। ভাইয়ের কাছ থেকে নেয়া ঋণসহ মোট আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ৭০ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬৩ টাকা। এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে অর্জিত সম্পদ ও ব্যয় বেশি পাওয়া গেছে ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার ১৩৯ টাকা। এসব টাকার আয়ের কোনো উৎস জাকির হোসেন জানাতে পারেননি। সে হিসাবে এসব টাকা তার জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ, যা দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সম্পদ বিবরণীতে ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ১০ হাজার থেকে ৮৫ হাজার পর্যন্ত ফরেন রেমিট্যান্স আসার কথা বলা হয়। কিন্তু হানিফুল ইসলাম নামের ব্যক্তি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন কি না, তার প্রমাণ ও রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি। এছাড়া রোকেয়া হোসেনের নামে আয়কর নথি না থাকায় তার ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য যাচাই করা যায়নি। জাকির হোসেনের দাবি অনুযায়ী, ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে জমি ক্রয়ের সত্যতাও পাওয়া যায়নি। জাকির হোসেন ও তার ওপর নির্ভরশীল এবং স্ত্রী রোকেয়া হোসেনের কাছে নিট সম্পদের পরিমাণ ৮৯ লাখ ৬৭ হাজার ৫৭১ টাকা।