উচ্চাভিলাষী রণদা

 

অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-১৮

মিজানুর রহমান শেলী: হারানোর নেই বাকি, দুর্জেয় জয়ে নাহি সংকোচ। কোনো বিহŸলতা রণদাকে বাধে না। ছোট কাজ কিংবা বড় কাজÑসব খানেই নিজেকে মানিয়ে নেন। নিরহঙ্কারী কিন্তু দৃঢ়চেতা, সদালাপি ও মিশুক প্রকৃতির মানুষ রণদার পেছন ফেরার নেই। তিনি বুঝে নিলেন, কেবল কুলির কাজেই জীবনের শেষ নয়। তাই স্থির থাকেননি। যখন যেমন কাজ পেয়েছেন, তা করেছেন। রিকশা চালিয়েছেন। ফেরিওয়ালা সেজেছেন। খবরের কাগজ বিক্রি ছাড়াও নিত্যনতুন কাজে তিনি ছিলেন। আরও কত কী!

কাজকে তিনি যেমন পেশা হিসেবে নিলেন, তেমনি এর মাঝেই জীবন, প্রাণমন খুঁজে ফিরলেন। কোথায় গিয়ে মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ তিনি পাবেন? কোথায় আছে বাবার দরদমাখা শাসনে আস্ফালনে জাতশক্তির স্পর্ধা। একাই চলতে হবে। কাজের মাঝেই তাকে পেতে হবে আপন-পর, মৃণয় থেকে চিণয়। এড়াতে হবে নিজেকেই, নিজের মনের কাছে।

বুঝে নিয়েছিলেন হা-ঘরে রণা, কেবল দিনমজুর বা কুলির কাজে জীবনের বড়াই চলে না। যদিও অহঙ্কার তারে ছুঁতে পারেনি। তবে প্রগতির স্বত্বগুণ তিনি অনুভ‚তি থেকে বুঝেছিলেন। কল্পনা, অভিজ্ঞতা আর আকুতি থেকে পেয়েছিলেন অপশক্তি নাশের লড়াকু সঞ্জীবনী। তার জন্য অবশ্য জ্যাঁ জ্যাঁক রুশোর রোমান্টিসিজমের ধারণা তাকে লাভ করতে হয়নি। জাতীয়তাবাদের ধারণাও তাকে আছড় করেনি তখনও। এ এক প্রাকৃত শিক্ষা। এ শিক্ষাই এক সময় পরিণত হয়েছিল গঠিত হয়েছিল। তিনি গঠন করেছিলেন মনে মনে, নিজের মনের কাছেই। তার জন্য অবশ্য নিজেকে মেলাতে হয়েছিল শূন্যে। ভাঙতে হয়েছিল বহুধা প্রতিঘাতে।

এ বোধ থেকেই তিনি বিভিন্ন পেশায় যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সর্বদা অপেক্ষাকৃত ভালো কাজের সন্ধান করেছেন। পড়ালেখা শিখতে পারলে যে আরও ভালো কিছু করা যেত ইতোমধ্যে, সে বোধটা তার প্রাণের মাঝে জেগেছে। এখন ক্ষণে ক্ষণে শৈশবের পড়ালেখায় অমনযোগিতা তাকে অনুতপ্ত করে, পরিতাপ জাগে। তবে হাল ছাড়ার কিশোর তিনি নন। নবদ্যোমে পড়ালেখা শেখার চেষ্টা তিনি শুরু করলেন। তৃতীয় শ্রেণিমানের পড়ালেখা তার পণ্ডিত হরিকান্তের কাছ থেকে শেখা হয়েছিল। সেই সম্বল নিয়েই তিনি শিয়ালদহ রেললাইন কিংবা অন্য কোনো ফুটপাতে বসেই পড়ার চেষ্টা করেন। ধীরে ধীরে পড়ালেখা বা খবরের কাগজের ওপর আগ্রহ জন্মে।

সে সময় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব সমাজেই খবরের কাগজে বিশ্বাস ছিল অগাধ। এই কাজে অংশ ছিল সম্মানের ও আভিজাত্যের। সম্ভ্রান্ত অনেক পরিবার থেকে পারিবারিক পত্রিকা বের হতো। দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো অনুসরণীয় মানুষেরা পত্রিকাকে কেবল পারিবারিক গণ্ডির মাঝে আভিজাত্যের নিশানা করে রাখেননি। ছড়িয়ে দিয়েছেন জাতি চেতনার আত্মশক্তির লড়াইয়ে। যাহোক, কিছুদিনের মাঝে  রণদাও শুরু করেন খবরের কাগজ বিক্রির কাজ। খবরের কাগজ বিক্রি করতে করতে তার পড়ালেখার সঙ্গে সৃষ্টতা আরও বাড়তে থাকে। তিনি পড়ালেখা শিখবেনই।

তাছাড়া ভালো কাজ পেতে হলে ইংরেজদের শরণাপন্ন হতে হবেÑএটাও তিনি বুঝে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আত্মশক্তি তৈরির যে আহŸান দিয়েছিলেন, তাতে তার পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং প্রপিতামহ পঞ্চানন কুশরীর ইংরেজদের সাহচর্যে আত্মোন্নয়নের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। খবরের কাগজে তখন এসব আলোচনাও ছিল টক অব দ্য টাউন। খবরের কাগজ পড়ে এবং খবরের কাগজের লোকদের সাহচর্যে রণদার মাঝেও এসব বোধ জেগেছিল। তখন কলকাতায় বিপিনচন্দ্র পালের নিউ ইন্ডিয়া, অরবিন্দ ঘোষের বন্দে মাতেরম, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সন্ধ্যা ও যুগান্তরের মতো পত্রিকা ছিল নবচেতনার বার্তাবাহক। এসব পত্রিকা বিক্রির সুবাদে তিনি সহজে তা পড়ার সুযোগ পেতেন। এমনকি এসব পত্রিকার একটি বড় অংশের পাঠক ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এই শিক্ষিত যুবকদের সাহচর্যও তাই তিনি অনায়াসেই লাভ করেন। অর্থাৎ নবচেতনার একটি শিক্ষা তার মাঝে বপন হতে শুরু করে।

একবার পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে অযোধ্যা চক্রবর্তীর সঙ্গে তার দেখা হয়। পরিচয়ের পর তারা জানতে পারেন, উভয়ে একই এলাকার সন্তান। অযোদ্ধা চক্রবর্তীর বাড়িও টাঙ্গাইল। জানা যায়, সে সময় অযোধ্যা চক্রবর্তী বাংলা অঞ্চলে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ফলে মেধাবী ছাত্র হিসেবে কলকাতায় তার একটি সুখ্যাতি ছিল। পরিচয়ের পর থেকে রণদা আর অযোধ্যা চক্রবর্তীর মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। রণদাও স্বেচ্ছায় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন। তবে এক্ষেত্রে রণদার একটি উদ্দেশ্য ছিল। আর সেটা হলো, রণদা ইংরেজি শিখবেন। অযোধ্যা চক্রবর্তী যেহেতু ভালো ইংরেজি জানেন, সেহেতু সেই তাকে ইংরেজি শেখাবেন। কেননা এখন নতুন করে স্কুলে গিয়ে পড়ালেখার সুযোগ তার ছিল না।

মিশুক রণদার সঙ্গে অযোধ্যা চক্রবর্তীর খাতির জমে যায় অল্পদিনে। রণদা ভাবতে থাকেন কীভাবে তার কাছ থেকে ইংরেজি শেখা যায়? তিনি কি আর ছিন্নমূল রণার জন্য বিনামূল্যে সময় দেবেন? অবশ্য রণদা ততদিনে মোটামুটি কলকাতার বেকার যুবক এবং শিক্ষার্থী ভাইদের জীবনাচারের উঁচাটান বুঝে নিয়েছিলেন। কলকাতায় তখন হাজার হাজার ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক। এদের অনেকেই ইংল্যান্ড থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে এসেছেন। অনেক কলকাতার সন্তান কলকাতাতেই ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছেন। একই সঙ্গে অনেক গ্রামের ছেলে গ্রামের আধুনিক স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করে এখন কলকাতায় ঠাঁই খুঁজছেন। কিন্তু এসব শিক্ষিত যুবাদের কোনো চাকরি-বাকরি নেই। মাঠে কাজ করতে গ্রামেও ফিরে যেতে পারছেন না। আবার মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করায় বৃহৎ সংখ্যক শিক্ষিত বেকারের ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করাও ছিল ছোট লোকি কাজ। তারা ব্রিটিশের কেরানিগিরি করেও সম্মান আর তুষ্টি খুঁজে পেতেন। আর বাকি শিক্ষিত বেকারের ছিল না কোনো ব্যবসায় উদ্যোগ নেওয়ার মতো যথেষ্ট পুঁজি। সরকারি অসহযোগিতা তো ছিলই। উপরন্তু অযোধ্যা চক্রবর্তী ছিলেন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। টাঙ্গাইল থেকে যথেষ্ট অর্থকড়ি নিয়ে কলকাতা গিয়ে তার পক্ষে পড়ালেখা চালানো, থাকা-খাওয়ার অর্থভার মেটানো সম্ভব ছিল না। এই নিদারুণ আর্থিক অনটনের জীবনে রণদা যে সহজেই অযোধ্যা চক্রবর্তীর কাছ থেকে সময় নিতে পারবেন, তা স্বাভাবিক। সামনে-পেছনে ভেবে রণদা অযোধ্যা চক্রবর্তীকে প্রস্তাব দেবেন বলে মনস্ত করলেন।

একদিন রণদা তার কাছে গেলেন। তিনি বলেন, দাদা, আমি আপনাকে প্রতি মাসে ২০০ টাকা দেব। আপনি আমার ইংরেজি শেখাবেন। এ কথা শুনে অযোধ্যা চক্রবর্তী হতচকিয়ে ওঠেন। অবাক হলেন। নিজের স্নায়ুচাপ ধরে না রাখতে পেরে তিনি রণদাকে তাচ্ছিল্য আর শাসনের ভঙ্গিতে পিঠের ওপর একটি চাপ্পড় দেন। এতে রণদা অবশ্য অপমানিত বোধ করেননি। বরং রণদা বলেন, হ্যাঁ দাদা সত্যি বলছি। চক্রবর্তী তখন বলে, এই তুই কত টাকা কামাই করিস। নিজেই তো খাবার জোটাতে পারিস না। প্রসঙ্গত সে সময় একজন সরকারি কেরানিও মাসে ২০ টাকার বেশি আয় করতে পারতেন না। অথচ রণদা এ সময় হুগলির নৌ-বন্দর থেকে কয়লা কুড়ায়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে টাকা জমাতেন। এ সময় কলকাতার কয়লা ব্যবসার রমরমা অবস্থা। তারা ব্রিটিশ ট্রেডার্সদের পাশাপাশি দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো ধনীরাও কয়লার ব্যবসায় বিশাল বিশাল লগ্নি শুরু করেছে। কয়লা তখন গৃহস্থ কাজে ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয়। রণদা বাজার দরেই কয়লা বিক্রি করতেন বাড়ি বাড়ি। কিন্তু তাকে কিনতে হতো না। কেননা, হুগলি নদী বন্দরে জাহাজে করে কয়লা সরবরাহ হতো। লোড-আনলোড করার সময় যে কয়লা এলোমেলো পড়ে থাকত, সেগুলোই রণদা কুড়াতেন। আজকের দিনে যাকে টোকায় বলা হয়। এই বিনা পুঁজির ব্যবসায় রণদা ভালো পয়সা কামাতেন।

জমানো টাকা সেদিন রণদা কোমরে গুঁজে নিয়েই গিয়েছিলেন অযোধ্যা চক্রবর্তীর কাছে। অযোধ্যা চক্রবর্তী যখন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তখন রণদা তার টেরি থেকে ২০০ টাকা বের করে দিয়ে বলেন, নিন ২০০ টাকা। এভাবে প্রতি মাসের শুরুতেই আমি আপনাকে দেব, আপনি আমাকে পড়াবেন। টাকা পেয়ে অযোধ্যা চক্রবর্তী হতবাক। কেন যেন একটু খেই হারিয়ে ফেলেন। এই পিচ্ছি রণা, শিক্ষা-দীক্ষার সনদ নেই, নেই কোনো ঠিকানা, কীভাবে সে এত টাকা কামায় করে? সে যেভাবেই করুক! কিন্তু আমি! নিজের শিক্ষা আর জ্ঞানকে তার কাছে সহসা অনর্থক-ব্যর্থ ঠেকতে লাগল। যেন টোকায় রণদা অযোধ্যার গালে একটি থাপ্পড় কষে দিলেন। এই ছিল কলকাতা শহর তথা বাংলার হালচাল: যেমন চাহর হয় একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের এই রাজধানী ঢাকা শহরে।

যাহোক, অর্থ-কষ্ট সবার আগে। জাত-পাতের হিসাব চলে না টাকার কাছে। অযোধ্যা চক্রবর্তী রাজি হলেন। এরপর থেকে রণদা এই অযোধ্যা চক্রবর্র্তীর কাছ থেকে ইংরেজি শিখতে থাকেন। তবে রণদাকে বেশিদিন ইংরেজি শিখতে লাগেনি। দু’মাসের মধ্যেই কথা বলার মতো ইংরেজি তিনি শিখে নিলেন। তখন রণদা গুরু অযোধ্যা চক্রবর্তীকে বলেন, দাদা আপনার কাছ থেকে যতটুকু শেখার তা আমি শিখে নিয়েছি।

এই ইংরেজি শিক্ষা ছিল রণদার কলকাতা জীবনের উত্তাল স্বদেশি আন্দোলনে এক কালাশ্রয়ী আত্মশক্তি। সেই শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি পেয়েছেন স্বায়ত্ত অসীমে একদণ্ড অধিকার।

 

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ

mshelleyjuÑgmail.com

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০