উচ্ছল শৈশব যেন আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে

শাহিদ আলী : প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আধুনিক যুগ সময়ের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগের আবর্তন যেন অনবরত চলছে। সভ্যতার বিকাশের ক্রমধারায় সময়ের গতির স্রোতধারায় আজকের এই নতুন পৃথিবী। প্রযুক্তি, কৃষি, বিজ্ঞান, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটার অবিরত গতি যেমন সভ্যতার চাকা ঘুরিয়ে দেয়, তেমনি এরই ধারাবাহিকতায়  সামাজিক বিকাশের এক অনন্য পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। আজকের সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, গ্রাম অঞ্চল, শহর প্রত্যেকটা জায়গায় বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলাফল হিসেবে মানুষের যাতায়াত, যোগাযোগ ইত্যাদি যেন চোখের পলকে করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে না সেটা কল্পনাই করাই যেন মূর্খতা। আমরা যদি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই এটি বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্রক্রিয়াটি শিশুদের সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার এক উদ্ভাবনী ক্ষমতা। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবার, বিদ্যালয়, স্থানীয় সংগঠন, ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। একটি শিশুর সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে উল্লিখিত উপাদানগুলো এক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু বর্তমানে সভ্যতার ক্রম বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির দরুন আজকের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চল ও শহর অঞ্চলের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায় শৈশবের বেড়ে ওঠার যে নিয়মশৃঙ্খলা তা যেন আগের শৈশবের চেয়ে আকাশ-পাতাল  ব্যবধান। আগে যেমন সূয্যি মামা জাগার আগে, পথিকের পথ চলা শুরু না হতে, শিশিরের শীতের সকাল উঁকি দিতে না দিতে মক্তবে, মাদ্রাসায়, বাসা বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াশোনার আমেজে চারপাশ যেন মুখোরিত হয়ে উঠত। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে গোসল করে সবাই একসঙ্গে হয়ে হইহুল্লো করে স্কুলের দিকে রওনা হতো। স্কুলের স্যারদের শাসন, আদর, ভালোবাসা, ইত্যাদি যেন অন্যদের কাছে গল্প করার মতো বিষয় ছিল। টিফিন শেষে খেলাধুলা করে গা ঘামিয়ে একমুঠো ভাত খেয়ে আবার ক্লাসে ফিরে আসা। বিকাল হলে ফাঁকা মাঠ কিংবা ধুলায় পরিপূর্ণ রাস্তার পাশে গাদল, গোল্লাছুট, ফুটবল, ক্রিকেট,  মার্বেল আরও কত খেলা সঙ্গে সাদা কালো টিভিতে মজার সিসিমপুর, আলিফ লায়লা  ইত্যাদির যেন নিত্যসঙ্গী ছিল।

সব বয়সী ছেলেরা মিলে যখন এসব খেলাধুলা মগ্ন তখন হালকা ফাজলামি মারামারি কেন বাদ দেয়ার মতো বিষয় হয়। অন্যদিকে মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলার সব বন্দোবস্ত চুকিয়ে এক ক্লান্তি, ঘামযুক্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরা হয়। টিউবওয়েল চাপিয়ে বদনায় পানি নিয়ে গোসল করে সলতে আর কেরোসিন দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে মায়ের কড়া শাসনে বই নিয়ে পড়তে বসা যেন অনন্য পরিবেশের জš§ দেয়। এর ফলে চারদিক পড়াশোনার এক মুখরিত পরিবেশ হয়ে ওঠে। রাত দশটা হতে না হতেই পড়াশোনার পাক চুকিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া যেন নিত্যদিনের রুটিন ছিল।

কিন্তু বর্তমানে শৈশবের বেড়ে ওঠা আগের শৈশবের সঙ্গে সঙ্গে যেন এক বিশাল ফারাক তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমানে সকাল হতে না হতে বাচ্চাদের ঘাড়ে এক বস্তা বই চাপিয়ে দিয়ে ঠেলে দেয়া হয় বিশাল মহাসাগরে। সারাদিন ক্লাস করতে করতে শিশুরা যেখানে হয়রান, বিকাল হতে না হতেই হোম টিউটরের আগমন যেন শিশুর এলার্জির প্রতিক্রিয়ার মতো অনুভব তৈরি করে দেয়। যেখানে বিকালে শিশুরা খেলাধুলায় মগ্ন থাকে সেখানে বর্তমানের শিশুরা থাকে চার দেয়াল বিশিষ্ট আবদ্ধ এক হোম টিউটরের সান্নিধ্যে। খালি পড়, পড়, পড়, এই বাণী যেন অভিভাবকের কথা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো মূল্যে তোমাকে ক্লাসে প্রথম হতে হবে, তোমার মেরিট পজিশনে এক হতে হবে এর বিনিময়ে যত হোম টিউটর, যত টাকা আমরা দিব এটাই যেন অভিভাবকের বিশাল চাওয়া।

আর এই বিশাল এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তারা বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। যে শিশুটাকে সবসময় পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা সিক্ত করা হয় সেই বয়সে তাকে শেখানো হচ্ছে ইংলিশ স্পিকিং। কেজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হচ্ছে একগাদা বই। আর সেই বই, খাতা, ব্যাগ এগুলোর গ্যাঁড়াকলে পড়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তেছে। যে বয়সে খেলাধুলা মগ্ন থাকে সেই বয়সে তারা পড়াশোনার এক চরম পরিবেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নিচ্ছে। সামাজিকীকরণের যে গাঠনিক ভূমিকা তা যেন অগোচরে রয়ে যাচ্ছে।  এর ফলে তারা সামাজিক শৃঙ্খল থেকে দূরে সরিয়ে কৃত্রিম ব্যস্ততম এক বিশাল দেয়ালযুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠছে। আর সেই দেয়ালের ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে হতাশা, আশাহীনতা, দুঃখ-কষ্ট প্রভৃতি যেন অভিভাবক, শিক্ষক সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবী থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। বর্তমানে যেখানে শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে মূল্যবোধ শেখার এক অতুলনীয় অবদান রাখছে সেটা হলো বাবা-মা। কিন্তু এখন দিনের পর দিন যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে এর সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় পেশাজীবী মা-বাবা সময় দিতে পারতেছে না তাদের বাচ্চাদের। ফলে বাচ্চারা বেশিরভাগ সময় আবদ্ধ ঘরে মোবাইল গেমস, টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির প্রতি আসক্তি বাড়তেছে। এর ফলে তারা অধিক সময় অতিবাহিত করছে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরনের গেমস, ফেসবুক, ইত্যাদিতে। ফলে তারা হারিয়ে ফেলছে তাদের শৈশব। একদিকে যেমন শৈশব হারিয়ে ফেলছে, অন্যদিকে তারা নিজেকে ফেলে দিচ্ছে এক বিশাল হুমকির মুখে। এতে শিশুদের ভিতরে অসামাজিক আচরণ প্রতিনিয়ত বাসা বাঁধছে, যার ফলে তাদের ভেতরে অল্প বয়সে হতাশা, চিন্তা জন্য ফেঁপে উঠছে।

রাজধানীর ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের একদল গবেষক ২০২১ সালে এমনই এক গবেষণা করেছিলেন। গবেষণার আওতায় তারা ঢাকার ১৯টি বিদ্যালয়ের ৬ হাজার ৪০১ শিক্ষার্থীর চোখ পরীক্ষা করেন। ঢাকার বাইরে বরিশাল, জামালপুর ও নওগাঁর বিভিন্ন বিদ্যালয়ের আরও ২৬ হাজার ৩৪৭টি শিশুর চোখ পরীক্ষা করা হয়। ঢাকার জরিপে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর চোখে ত্রুটি পাওয়া যায়। আর ঢাকার বাইরে এই হার ছিল ১৪ শতাংশ। তাদের এই গবেষণার চাঞ্চল্যকর তথ্যের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে শিশুরা অধিক সময় মোবাইল ফোনে আসক্তি, বাইরে পরিবেশ থেকে তাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা না করা প্রভৃতি। তাছাড়া তাদের এই উপসর্গের কারণ হিসেবে আমরা নিজেরাই দায়ী।

মানুষের শৈশব যেন এক মধুরতম সময়, যে সময়ে শিশুরা নিজেকে ছাড়িয়ে দেবে এক অপার সম্ভাবনার দ্বারে। সামাজিকীকরণের প্রত্যেকটা স্তরে তাদের পদচারণা থাকবে, যার ফলে মূল্যবোধের ভিত্তি হবে মজবুত। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সামাজিক যে অবস্থা তা যেন অচিরে শৈশবকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই অভিভাবক যদি তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে পর্যালোচনা  না করেন তাহলে মূল্যবোধের যে গুণাবলি  তা কখনোই রোপিত হবে না এবং তারা দিনের পর দিন শৈশবের সুসময়ের দিনগুলো থেকে হারিয়ে যাবে ।

 

শিক্ষার্থী

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০