মো. জিল্লুর রহমান: গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পর পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে’ বিভিন্ন এলাকায় একদল মানুষের একজোট হয়ে ‘নিজেরাই বিচার’ করে ফেলার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে সমাজে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, যা ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, আইন কোনোভাবেই হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। কিন্তু যারা এসব কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্তও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞের মতে, এসব ঘটনায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি, আইনের শাসনের প্রতি অনীহা এবং ভবিষ্যতে ‘প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা’ তৈরি করতে পারে। তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো বিচারিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে। মানুষ যদি বিচার ব্যবস্থাকেই বিশ্বাস না করে, নিজেরাই ‘মব জাস্টিস’ করতে থাকে, তাহলে বিচার ব্যবস্থার আর দরকার কী? এ কারণে যে কোনো মূল্যে এসব অতি উৎসাহী তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
আসলে মব জাস্টিস বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার গণবিচার মূলত একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অধিকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ধরনের শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে গণতন্ত্র বা অন্যান্য বৈধ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থার তুলনায় পুরো সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল একটি নাগরিক প্রক্রিয়ার অভাব বা ক্ষতি বিদ্যমান থাকে। এটি হলো গণতন্ত্রের একটি অবক্ষয়িত রূপ, যেমনভাবে সাম্রাজ্যবাদ সর্বাতন্ত্রবাদ বা অভিজাততন্ত্র অলিগার্কিতে পরিণত হতে পারে। শব্দগতভাবে, গণতন্ত্র হলো ‘জনগণের শাসন’, যা সাধারণ ইচ্ছার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। কিন্তু মব জাস্টিস হলো ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার গণবিচার’, অর্থাৎ যারা রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করার সময় একটি দূষিত ইচ্ছা প্রদর্শন করে, যা বিভ্রান্ত ও অযৌক্তিক এবং এর ফলে তাদের স্বশাসন ক্ষমতা থাকে না এবং তারা জনগণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি পূরণ করতে পারে না।
অতি সম্প্রতি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেন একদল শিক্ষার্থী। আর জাহাঙ্গীরনগরে বিগত সরকারের ছাত্র সংগঠনের সাবেক এক নেতাকে কয়েক দফা মারধর করে হত্যা করা হয়। এ দুটি ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে থানায় মামলা করেছে এবং এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ অভিযুক্ত ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, তাদের একজন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগী নেতা, অন্যদের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক ও ছাত্রদলের চার নেতাকর্মীসহ কিছু শিক্ষার্থী জড়িত বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ককে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে ও ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
অন্যদিকে খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার জের ধরে জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে কয়েকজন নারীকে হেনস্তার ঘটনাটি নিয়েও তুমুল আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। জানা যায় সম্প্র্রতি এক যুবক কয়েকজন সঙ্গী সাথিকে নিয়ে একটি দল গড়ে তুলে একাকী ভ্রমণে যাওয়া নারীদের লাঞ্ছনা করে ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করার পর তুমুল সমালোচনার মুখে তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এরও আগে ঢাকার শ্যামলীতে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী সন্দেহে কয়েকজন নারীকে মারধর করে আরেক ব্যক্তি নিজের ফেসবুক আইডিতে ভিডিও প্রকাশ করে।
ছাত্র-জনতার প্রবল গণ-আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আক্রমণ হচ্ছে, মাজারে মাজারে হামলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাউকে কাউকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘স্বউদ্যোগে অভিযানে’ যেতে দেখা যাচ্ছে এবং সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় ‘মব জাস্টিস’ চলতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের জেরে দেশজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাতেও সমালোচনা হচ্ছে। তাছাড়া বিগত সরকারের কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীকে আদালতে তোলা হলে তাদের ওপর হামলা করে একদল বিক্ষুব্ধ আইনজীবী। আক্রোশের জেরে আদালতে পুলিশের সামনেই আসামিদের ওপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটানো হয়েছে, এই প্রবণতা অবশ্যও এখন কিছুটা কমেছে। যদিও আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের মাধ্যমে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কোনো ক্রমেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়।
আসলে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সেটির জন্য প্রচলিত আইন, প্রশাসন আছে, বিচার ব্যবস্থা আছে। আইন অনুযায়ী সবকিছু হলেই সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে, শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আইনের বাইরে গিয়ে এমন পরিস্থিতি কখনই কাম্য নয়। ‘মব জাস্টিসের’ নামে নৈরাজ্য কখনই গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানও নয়। গত ৮ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও বিষয়টি ওঠে আসে। সেই আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘মব জাস্টিসের বিষয়ে সরকারের অবস্থান খুব স্পষ্ট। কোনোভাবে হতে দেয়া যাবে না। কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ নেই।’ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে শাস্তি পেতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
আইনের শাসনের অর্থই হচ্ছে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাই আইনের অধীন। অন্য কথায় আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমান অধিকার প্রাপ্তির সুযোগকে আইনের শাসন বলে। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান-এর অর্থ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ -লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে আইনের সমান আশ্রয় লাভ করা। ফলে ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল সবাই সমান অধিকার লাভ করে। আইনের শাসনের প্রাধান্য থাকলে সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকবে এবং জনগণ আইনের বিধান মেনে চলবে। আইনের শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। আইন না থাকলে সমাজে অনাচার অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকলে নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সামাজিক মূল্যবোধ, সাম্য কিছুই থাকে না। সাম্য, স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের শাসন অত্যাবশ্যক।
সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন। এটি একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও বৈধ উপকরণ। মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আইনের শাসন। প্রশাসনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আইনের শাসন থাকা দরকার। আইনের মাধ্যমেই স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা ও আধিপত্য রোধ করা যায়। আইন হতে হবে অবশ্যই নিরপেক্ষ। শাসন তখনই ভালো বা সুশাসন হয় যখন, সরকার সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর উপকার বা মঙ্গল করে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হচ্ছে সুশাসনের প্রধান উপাদান। এটি সরকারের স্বচ্ছতা ও আইনের শাসনের ওপর নির্ভর করে। জবাবদিহিতার মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয় বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের জবাবদিহিতাও আবশ্যক। দুর্নীতি কমাতে ও রাজনৈতিক উন্নয়নে জবাবদিহিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আইনের শাসনের মাধ্যমেই শাসক ও শাসিতের সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সরকার স্থায়িত্ব লাভ করে এবং রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অভাবে অবিশ্বাস, আন্দোলন ও বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। আর বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও হানাহানি সমাজের শক্ত ভিতকে দুর্বল করে তুলে। সমাজে ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বলের ভেদাভেদ প্রকট আকার ধারণ করে। সুতরাং সামাজিক সাম্য, নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সমাজ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য। আইনের শাসন একটি সভ্য সমাজের মানদণ্ড।
দেশজুড়ে একের পর এক মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের মধ্যে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক বার্তায় বলা হয়, এসব হামলার সঙ্গে জড়িতদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। আসলে মব জাস্টিস কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। এখন যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ভবিষ্যতে তিনিও আরেকটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন। একটি মব আরও অনেকগুলো মব বয়ে নিয়ে আসে। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে, কিন্তু সে জায়গায় না গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটি আইনের শাসনের পরিপন্থি।
বিগত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় হামলা, হত্যা, গুম, গায়েবি মামলা, ক্রস ফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ছিল আলোচিত ঘটনা এবং বিচার ব্যবস্থাও বিগত সরকারের ইশারা ইঙ্গিতে চলত বলে অভিযোগ। এ কারণে সরকারের পদত্যাগের পর একটি জনরোষ তৈরি হয়েছে এবং অনেকেই আইন হাতে তুলে নিতে চাচ্ছে। তবে ভুক্তভোগীরা মব জাস্টিস নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় যেভাবে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে অন্যান্য ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং তখন কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার দুঃসাহস দেখাবে না বলে অনেকের বিশ্বাস।