Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:40 pm

উজার হচ্ছে বন, হুমকির মুখে শেরপুরের গারো পাহাড়

রফিক মজিদ, শেরপুর: সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুর। মেঘালয় রাজ্য সংলগ্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড় ঘেরা শেরপুর জেলার তিন উপজেলা ঝিনাইগাতি, শ্রীবরর্দী ও নালিতাবাড়ী। যদিও মূল গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মধ্যে পড়েছে। তবে কিছু অংশ অসম রাজ্যে এবং কিছু অংশ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের শেরপুর জেলার ওই তিন উপজেলা সীমান্তে যে পাহাড় রয়েছে তা গারো পাহাড়ের আংশিক এবং নামায় পড়েছে। ভারতীয় অংশের মূল গারো পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফিট উচু। আর এর বিস্তৃত দৈঘ্য প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং বনাঞ্চল রয়েছে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে। শেরপুর অঞ্চলের পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা রয়েছে প্রায় ২০০ থেকে ৫০০ ফুট মাত্র। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট ধ্বংসের কারণে শেরপুর অঞ্চলের গারো পাহাড় আজ হুমকির মুখে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শেরপুর অঞ্চলের এই গারো পাহাড়ের উচ্চতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৩ ইঞ্চি করে মাটি ক্ষয় হয়ে নিচু বা ডেবে যাচ্ছে এই গারো পাহাড়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাহাড়ে অনাবৃষ্টি ও খড়ায় বনের গাছ শুকিয়ে মরে যাওয়া, বনের বন্য প্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালিও পরিবেশ বিপর্যয়ের সাথে সাথে তারা অন্যত্র বাসা বেঁধেছে, আবার অনেক পশু-পাশি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বন থেকে। এছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন ছড়া বা ঝোড়ায় পানি না থাকায় মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর খাবার পানি সংকট দেখা দেয়ায় বন থেকে ইতিমধ্যে অনেক প্রাণী ও পাখ-পাখালি বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হিসেবে দেখছে পশু-পাখি বিশেষজ্ঞরা। এদিকে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বন-পাহাড়ে এসে ওইসব ভুমিহীনরা বসতি স্থাপন করে অরণ্যকে করে ফেলেছে লোকালয়। সেইসাথে বনের ভিতর মানুষের এই বিচরণের কারণে বনে শুরু হয় পাথর উত্তোলন, বালু উত্তোলন, গাছ কাটা, পাহাড়ি টিলায় সবজি চাষ, মাছ চাষ, বিভিন্ন ফলের বাগান সহ নানা চাষাবাদ।

কৃষি ও পরিবেশবাদীরা জানায়, বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ে পাথর-বালু উত্তোলন এবং পাহাড়-বনে চাষাবাদের কারণে মাটির ক্ষয় বেড়ে গেছে অনেক। পাহাড়ি টিলা ও টিলার নিচের মাটি বা জমিতে এই চাষাবাদের কারণে ব্যাপক ভাবে মাটির ক্ষয় শুরু হয়েছে। সারা বছর পাথর-বালু উত্তোলন এবং চাষাবাদের কারণে মাটি নরম হয়ে থাকে। এরপর বর্ষায় বৃষ্টির কারণে সে মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে পাহাড়ের মাটি দিন দিন সড়ে গিয়ে ক্রমেই সমতল ও নিচু হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। কেউ কেউ আস্ত পাহাড় কেটে সমতল করে চাষাবাদ ও ঘর-বাড়ি নির্মান করে বসতি স্থাপন শুরু করেছে। বন ভুমি দখল করে কেউ কেউ আবার মৎস চাষও করছে। এসব কারণে ইতিমধ্যে পরিবেশ ও পাহাড়ের ভারসাম্য রক্ষাকারী হাতির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়েছে। হাতির বিচরণ ক্ষেত্র ও আবাসস্থলে বসতি গড়েছে মানুষ। ফলে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ, হত্যা হচ্ছে হাতি।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, জেলার ৩ টি রেঞ্জের সীমানা দূরত্ব প্রায় ৩৬ কিলোমিটার। এই ৩৬ কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড় ও বনাঞ্চল দেখাশোনার জন্য কর্মকতা ও বনরক্ষীসহ লোকবল রয়েছে মাত্র ৩৪ জন। এরমধ্যে ১২ জনের বয়স প্রায় ৬০ বছরের উপরে। এতো বড় বনাঞ্চলে মাত্র ৩৪ জন বনরক্ষী ও বন কর্মকর্তা দিয়ে বন পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি অতিগুরুত্ব দিয়ে বন-পাহাড় রক্ষায় আশুব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন। তা না হলে বন ধ্বংসের পাশাপাশি দেশের এই ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়ও এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে।

জেলা বন বিভাগ সূত্র মতে, উল্লেখিত তিন উপজেলা ঘিরে রয়েছে ২৮ হাজার ২৫১.৫০ একরের বিশাল বনভূমি। এর মধ্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৩৯১.১৭ একর জমি জবর দখল হয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবী দখলের পরিমান আরও বেশী হবে। প্রতিদিনই দখল হচ্ছে বনের জমি। বনের জায়গা দখল করে সমতল করে তৈরি করা হচ্ছে কাঁচা, পাকা দালান, সবজির বাগান। ফলে শ্রী হারাচ্ছে বন। বিপর্যয় হচ্ছে পরিবেশের।

সূত্র জানায়, শেরপুর জেলায় বালিঝুড়ি, রাংটিয়া ও মধুটিলা নামে তিনটি ফরেষ্ট রেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে বালিঝুড়ি রেঞ্জের বনের জমির পরিমান ৮৩৪৫.৫০ একর, দখল হয়েছে ৪৭৭ একর। রাংটিয়া রেঞ্জের জমির পরিমান ৮৮০২.৮১ একর, দখল হয়েছে ১৪২৬.৫ একর। মধুটিলা রেঞ্জের জমির পরিমান ৪২৮২,২৯ একর, দখল হয়েছে ৫৮৯.৬২ একর। মোট ভূমির অবশিষ্ট ৬৪২০.৭০ একর ও দখলকৃত ৮৯৮.৫০ একর জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। সূত্র জানায়, এই বিশাল বনভূমি দখল করে আছে নদীভাঙা মানুষ, বাঙালী ও আদিবাসীসহ ৩৯০১ জন।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বালিজুড়ি রেঞ্জের হাড়িয়া কোনা, দিঘলা কোনা, বাবলা কোনা, জোলগাও, ডুমুরতলা রাংটিয়া রেঞ্জের হলদীগ্রাম, গাড়োকোনা, গোমরা, মধুটিলা রেঞ্জের সন্ধাকুড়া, কালাকুমা, তাড়ানী এই সব জায়গায় বানিজ্যিকভাবে বনের জায়গা দখল করে চাষ হচ্ছে সবজিসহ নানা ফসল। এই বন দখলের পিছনে মদদ দিচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে মজম আলী, মোতালেব হোসেন বাচ্চা কেল্লা, আব্দুর রহিম (ভারতীয় চোরাই গরু ব্যাবসায়ী) আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে ব্রতীন কোমার মারাক, লুজি মেরী সহ স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এবং রাজনৈতিক নেতা, সাবেক ও বর্তমান এক শ্রেণীর অসাধু বনকর্মী। বাঁধা দিলেই উল্টো দখলকারিরা এক হয়ে হামলা-মামলা ও আন্দোলন করে। বনের জমি নিয়ে আদিবাসি, বাঙালি ও বন বিভাগের একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আবার সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে দখলকারিদের সাথে আপোষ করারও বিস্তর অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামি দশকে এটাকে আর বনভূমি বলা যাবে না। গাছপালা থাকবো কোন, ছোট ছোট টিলার উপর হয়ে যাবে গ্রাম ও শহর। ফলে গারো পাহাড় হয়ে যাবে পাহাড়ি নগর বা লোকালয় গ্রাম।

বালিজুড়ি খ্রিস্টান পাড়ার আদিবাসী কৃষক জন উইথ এবং নাম না বলার শর্তে একাধিক কৃষক জানায়, হাড়িয়াকোনা, দিঘলাকোনা, বাবলাকোনা, জোলগাও, ডুমুরতলা এবং খ্রিস্টান পাড়ায় প্রায় দেড়শত কৃষক আশি একর বনভূমির জায়গা দখল করে সবজি চাষ করছে। তারা আরও জানায়, এ অঞ্চলের মাটি খুবই উর্বর হওয়ায় কৃষকদের সবজি চাষ দিন দিন বাড়ছে।

গজনী এলাকার কৃষক হেকমত আলী বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে আমরা বন বিভাগের জায়গায় আছি চাষাবাদ করছি এখন আমাদের উচ্ছেদ করলে আমরা কোথায় যাবো ।

বালিঝুড়ি ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জোহর বলেন, আমি ইতিমধ্যে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি সবজির বাগান ধ্বংস করেছি এবং আর যেন সবজির বাগান ও বাড়ি-ঘর নির্মান না হয় সে বিষয়ে কৃষকদের সতর্ক করে যাচ্ছি।

রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: সুমন মিয়া বলেন, আমি নতুন আসছি তবে হলদীগ্রাম, গাড়োকোনা, গোমরায় সবজি চাষ হচ্ছে এটা শুনেছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে সমন্বয় করে দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। ইতিমধ্যে গত ৬ ডিসেম্বর রাংটিয়া বিটের গান্ধিগাঁও গ্রামের দুইটি অবৈধ দখলদারের নির্মানাধীন ঘর উচ্ছেদ করেছি। উচ্ছেদ অভিযান চলবে।

পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা মুগনিউর রহমান মনি জানান, গাড়ো পাহাড়ের গহীন অরন্যে অবৈধভাবে সবজি আবাদের ফলে পাহাড়ের গঠন নষ্ট হচ্ছে পাশাপাশি ‍ভূমিক্ষয় সহ প্রাকৃতিক বন নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিধ্বস ঠেকাতে কঠোর আইনি ব্যাবস্থা গ্রহন করা উচিত।

ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম ওয়ারেজ নাঈম বলেন, দখলদারদের অত্যাচারে পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এই দখলদারদের বিরুদ্ধে সরকারের আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত এবং আমি নিজেও জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।

শ্রীবর্দী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার বলেন, বনের জায়গা দখল করে সবজির আবাদ করতে দেওয়া হবে না। কৃষকরা সবজি চাষ বন্ধ না করলে প্রয়োজনে অভিযান করা হবে এবং মামলা দেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, সবজি চাষ কিংবা বাড়ি-ঘড় নির্মানের নামে কাউকে বনের জায়গা দখল করতে দেওয়া হবে না। তবে পৃর্বে যে সব বাড়ি-ঘড় নির্মান হয়েছে সে গুলোর ব্যাপারে সরকার চিন্তা করবে ।

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসেন চৌধুরী জানান, অবৈধ দখলদারদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা সুনির্দিষ্ট এ্যাকশান প্ল্যান তৈরী করছি। প্রতি বছর কী পরিমাণ জমি দখল হচ্ছে সেটাও আমরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহন করছি। শেরপুরের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়েই দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধার করতে হবে।

এবিষয়ে শেরপুর-৩ (শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতী) আসনের এমপি ফজলুল হক চান বলেন, বহু পৃর্বে থেকেই বনের জমি দখল হচ্ছে। উচ্ছেদ এবং মামলা করেও দখল থামানো যাচ্ছে না। তবে সরকার বনের জমি উদ্ধারে আন্তরিক রয়েছে।