উঠে যেতে পারে ঋণ বিতরণে সুদহারের বাধ্যবাধকতা

জয়নাল আবেদিন; ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে দুই বছরের মধ্যে সংস্থাটি পিছু হটতে যাচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত থেকে। নতুন মুদ্রানীতিকে কেন্দ্র করে এমন আলোচনা এখন ব্যাংক কর্মকর্তাদের মুখে মুখে। বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের শেষ মুদ্রানীতিতে ঋণ বিতরণে ৯ শতাংশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত উঠে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংকে গতকাল নতুন মুদ্রানীতির নীতিনির্ধারণের বিষয় নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজও হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। নির্ধারণ করা হবে ঋণ ও আমানতের সুদের হার ও বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির হার। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে মুদ্রানীতির দিন (এই মাসের শেষ সপ্তাহে)।
নিয়ন্ত্রিত সুদহার চালুর আগে ব্যাংকগুলো নিজেরাই যেন ঋণে ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে সে চেষ্টা ছিল সরকারের। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠক থেকে সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নানা সুবিধা নিয়েছে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার কমানো, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার (রেপো) সুদহার কমানোসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব সুবিধার একপর্যায়ে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ও আমানতে ছয় শতাংশ সুদহার নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি। পরবর্তী সময়ে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা করেনি। তাই ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন চাপে সেই সিদ্ধান্ত আবার পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশে উঠেছে। টানা আট মাস ধরে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। সবশেষ এপ্রিলে তা আরও বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর জুলাইয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে তাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সে হিসাবে, মার্চ শেষে উদ্যোক্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে
এখনও কম ঋণ নিয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। এর অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের চিত্রও ছিল হতাশাজনক। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে তা আরও কমতে থাকে। প্রতি মাসেই কমতে কমতে গত বছরের মে মাসে তা ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনি¤œ।
অতীত ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে ব্যাংকের ঋণ বাড়তেই থাকে। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশের বেশি। বছরওয়ারি হিসেবে এরপর তা সব সময়ই ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এমনকি একপর্যায়ে তা ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তা দুই অঙ্কের নিচে (ডাবল ডিজিট) ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমে আসে। এরপর দুই বছর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের নিচে (সিঙ্গেল ডিজিট) ছিল। কিন্তু সে ধারা থেকে বেরিয়ে আবার ডাবল ডিজিটে উঠে এসেছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। তারপরও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি বেসরকারি খাত। এই খাতের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বিষয়ে চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০