উত্তরা ব্যাংকের দেনা শোধ করতে পারছে না সাদ মুসা গ্রুপ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন রপ্তানির জন্য ২০১৫ সালে সিআইপি খেতাব পান। এরপর এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ছন্দপতন হয় ব্যবসায়। অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, ফান্ড ব্যবস্থাপনার অভাব, করপোরেট সংস্কৃতি চর্চার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ডুবেছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবসা।

খেলাপির কারণে এরই মধ্যে ছাড়তে হয়েছে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের পরিচালক পদ। ব্যবসার প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিলেও সময়মতো পাওনা পরিশোধে একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছেন। তাই খেলাপি পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড আদালতের দ্বারস্থ হয়। ব্যাংকটির লালদীঘি শাখা গত ২৯ জানুয়ারি সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৭৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করে।

উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড লালদীঘি শাখা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন। পোশাক খাতের একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেন সাদ মুসা গ্রুপ। এসব কোম্পানি আয় দিয়ে বাড়িয়েছেন অন্যান্য ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তবে ব্যবসায়িক ব্যর্থতায় ডুবেছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবসা। এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড থেকে ঋণসুবিধা গ্রহণ করেন। প্রথমদিকে নিয়মিত ঋণ থাকলেও পরে অনিয়মিত ঋণে পরিণত হয়। গত ২০১৯ সাল থেকে ব্যাংকটির নিয়মিত পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। আর এ পাওনা পরিশোধে অনেকবার তাগাদাও দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ খেলাপি পাওনা আদায়ে বন্ধকিতে থাকা সম্পত্তি নিলামে বিক্রয়ে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই ব্যাংক ব্যর্থ হয়। পরে ব্যাংকটির লালদীঘি শাখা গত ২৯ জানুয়ারি সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৭৫ কোটি ৪৯ লাখ ২২ হাজার ৬০৯ টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করে, যার নম্বর ১৫/২০২০।

এ প্রসঙ্গে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড লালদীঘি শাখার ব্যবস্থাপক ও এজিএম মোহাম্মদ গোলাম ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেডের প্রায় সাড়ে ৭৫ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ঋণ আদায়ে আমরা অনেক চেষ্টা করি। এমনকি বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রয়ের মাধ্যমে পাওনা আদায়ের উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখায়নি। পরে আমরা আইনি প্রক্রিয়া পাওনা আদায়ে চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহসিন সাহেবের অদূরদর্শী বিনিয়োগের কারণে গ্রুপের অবস্থা খারাপ হয়েছে। অথচ তিনি ২০১৫ সালে রপ্তানিতে সিআইপি পদক অর্জন করেছিল। এ গ্রুপের অবস্থা ২০১৬ সাল থেকে খারাপ হতে থাকে, যা ২০১৮ সালের দিকে প্রকাশ হয়। এখন তো তার মালিকানাধীন সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। তবে তিনি সবসময় আশা প্রকাশ করেন ব্যবসা আবারও ভালো হবে। কিন্তু এসব আশার কোনো ভিত্তি পাচ্ছি না।’

ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানা যায়, ১৯৮২ সালে পোশাক খাত দিয়ে ব্যবসা শুরু করে সাদ মুসা গ্রুপ। চট্টগ্রামের পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন চট্টগ্রাম ফেব্রিকস বোর্ড লিমিটেড, সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেড, এমএ রহমান ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, সাদ মুসা হোম টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লথিং লিমিটেড, দেশ কম্পিউটার, মার্স অটোমোবাইলস, সাদ মুসা হাউজিং কমপ্লেক্স লিমিটেড, হাসনি বনষ্পতি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, আল মুস্তফা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আহমদি অয়েল মিলস লিমিটেড, ক্রিসেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রোকেয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড, এমদাদ এতিমিয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড, সুলতান হাবিবা ফেব্রিকস লিমিটেড, মাহমুদ সাজিদ কটন মিলস লিমিটেড, সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, কর্ণফুলী জুট ট্রেডিং একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ফেব্রিকস, স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কারখানা চালুর ধারাবাহিতকায় আনোয়ারায় স্থাপন করেন রপ্তানিমুখী শিল্পপার্ক। তবে জ্বালানি অনিশ্চয়তাসহ নানা ধরনের জটিলতায় সংকটে পড়ে গ্রুপটি; যা পুরো গ্রুপ ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বৃহৎ এ গ্রুপের ব্যবসায় পরিচালনার জন্য দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ সুবিধা নেন। এর মধ্যে গ্রুপটির কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০১৮ সালের সমাপ্ত হিসাববছরের শেষে মোট পাওনা দাঁড়ায় ৬৪৯ কোটি টাকা, যা আগের ২০১৬ সালে ছিল ৬৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া এক্সিম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মোট পাওনার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাওনা আদায় নিয়ে চিন্তিত কয়েকটি ব্যাংক। শুধু তাই নয়, এ ব্যবসায়ীকে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের পরিচালক পদ ছাড়তে হয়। এছাড়া কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নামে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। কর ফাঁকি ও আয়কর রিটার্নে বিদেশে বিনিয়োগের তথ্য গোপনের অভিযোগও বিচারাধীন আছে।

এ বিষয়ে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এখন অর্থনৈতিকভাবে চাপে আছি। এখন শ্রমিকের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ ৩৭ বছরের ব্যবসায় আমাদের কোনো দুর্নাম ছিল না। আপনি দেখলে দেখবেন আমাদের মতো বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এমন গ্রুপ  নেই। গত কয়েক বছরের চট্টগ্রামে ৩০০ মতো কারখানা বন্ধ হয়েছে। আমরা অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠান চালু রেখেছি। হয়তো আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে আবারও ভালো অবস্থায় ফিরে আসব।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০