উত্তরে কমতে শুরু করেছে পানি বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক

শেয়ার বিজ ডেস্ক: ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর টানা বৃষ্টির পানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে উত্তরের নদ-নদীগুলো। বিশেষ করে তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদ-নদীবিধৌত রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তীব্র নদীভাঙনের কবলে পড়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। ভাঙনে বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন অনেকেই।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, রোববার রাত ৯টায় রংপুরে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৯ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার, যা (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার) বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে একই পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টায় পানির প্রবাহ বিপৎসীমার ৩১ এবং বিকাল ৩টায় বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এদিন দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টায় পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার, যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে হয়। বিকাল ৩টায় একই পয়েন্টে পানির প্রবাহ বিপৎসীমার আট, দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার তিন, সকাল ৯টায় বিপৎসীমার এক সেন্টিমিটার নিচ এবং সকাল ৬টায় বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গত আট ঘণ্টায় (সন্ধ্যা ৬টার আগ পর্যন্ত) উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি।

সূত্র আরও জানিয়েছে, রংপুর বিভাগের তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, দুধকুমার নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে; অপরদিকে ধরলা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি সমতল রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, অপরদিকে ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রংপুরের তিন উপজেলায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা নদীবেষ্টিত গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা, আলমবিদির, নোহালী, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর, হারাগাছ, ঢুসমারা, শহীদবাগের গান্নার চর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও পাওটানার প্রায় ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বন্যার আতঙ্কে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষের নির্ঘুম রাত কেটেছে। এমন আকস্মিক বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়ছেন বানভাসীরা। এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো বন্যার কবলে পড়ল তিস্তাপাড়ের মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে, যা রাতে আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া পানি বাড়ায় তিস্তাসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় মনিটরিং করা হচ্ছে, যাতে রাস্তাঘাট ও ব্রিজ ভেঙে না যায়, সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
লালমনিরহাটে আকস্মিক এ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ বিপৎসীমার কাছাকাছি থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে এখানকার মানুষেরা। নদীতীরবর্তী এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরের মাছ।

সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এলাকার সাগর মিয়া বলেন, শনিবার রাতে পানির গর্জনে ঘুমাতে পারিনি। সলেডি স্প্যার বাঁধে ব্রিজ অংশের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ সময় বাঁধ কাঁপছিল। আমরা ভয় পেয়েছিলাম যে, স্প্যার বাঁধ বুঝি ভেসে যায়। স্থানীয়রা রাত জেগে বাঁধে বস্তা ফেলে রক্ষা করেছে। বন্যার সময় নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তাপাড়ের মানুষদের। একই গ্রামের আব্দুর রশিদ ছোট বলেন, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হাঁটুপানি। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে পড়েছি। শুকনো খাবার প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত আসেনি। এবারের বন্যায় তেমন কেউ খবর নিতেও আসেনি।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনিল কুমার বলেন, রোববার সকাল ৬টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বেড়ে বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুপুরে তা কমে গিয়ে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে। আশা করছি দ্রুতই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
কুড়িগ্রামে বাড়ছে ভাঙন আতঙ্ক কুড়িগ্রামে ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্লাবিত হয়েছে তিস্তার তীরবর্তী রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ, উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া, বজরা, থেতরাই, গুনাইগাছ ও চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের আংশিক অংশ। এসব ইউনিয়নের চর ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় চার শতাধিক পরিবার, গ্রামীণ কাঁচা সড়কসহ ১৫৯ হেক্টর জমির রোপা আমন এবং মৌসুমি ফসলের ক্ষেত নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।

রাজারহাট উপজেলার খিতাব খাঁ গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, আমার তিন বিঘা জমিতে আধা পাকা ধান ক্ষেতে হঠাৎ তলিয়ে গেছে। কিছু ধান কাটতে পারলেও অবশিষ্ট সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আমার খুব ক্ষতি হয়ে গেল। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ জানায়, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বৃদ্ধি পেলেও তা বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, খিতাব খাঁ মাঝের চরের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারদের জন্য এক কেজি মুড়ি, আধা কেজি চিড়া, খাবার স্যালাইন, মোমবাতি, দিয়াশলাই ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা বেগম।

গাইবান্ধার নদ-নদীতে বিপৎসীমার নিচে পানি গাইবান্ধার প্রধান চার নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এতে জেলার ১৬৫টি চরের নিম্নাঞ্চলে পানি উঠতে শুরু করেছে। তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গাইবান্ধার প্রধান তিন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আপাতত জেলায় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে পাউবো। গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক দিন থেকে ধীর গতিতে প্রধান চার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৭৪ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার ও করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ৭৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদী। হঠাৎ পানি বাড়ায় তারাপুর, হরিপুর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, বেলকা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর, কামারজানি ও সাঘাটার হলদিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে ফের পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। এরই মধ্যে নিম্নাঞ্চলের চরগুলোয় পানি প্রবেশ করেছে। এতে স্থানীয়দের মাঝে নতুন করে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে। চরের নিম্নাঞ্চলে আবারও পানিবন্দি হওয়ার শঙ্কা করছে সাধারণ মানুষ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০