Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 1:35 pm

উত্তর ও পূর্বাঞ্চল ছাড়িয়ে বন্যা এখন মধ্যাঞ্চলে

শেয়ার বিজ ডেস্ক: চলমান বন্যা উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ছাড়িয়ে এখন দেশের মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে। গতকাল বুধবার অধিকাংশ বন্যাপ্লাবিত এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবমতে, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ পর্যন্ত ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট ২২ জেলা এখন বন্যার কবলে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এখন ৩৩ লাখ ২৭ হাজার বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত মাঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ২২ জেলায় বন্যায় আট লাখ ৭০ হাজার ৫২ পরিবারের ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর ও রাঙামাটি জেলার ১২২টি উপজেলা এবং ৩৮টি পৌরসভা এখন বন্যায় প্লাবিত।

এদিকে আগামী তিন দিন গঙ্গা-পদ্মায় পানি বাড়তে থাকবে। পদ্মার গোয়ালন্দ ও ভাগ্যকূল পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর উজানে পানি কিছুটা কমায় কুড়িগ্রাম-রংপুর অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে জামালপুর, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। নতুন করে ঢাকার পূর্বাঞ্চলসহ দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বন্যায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দিনাজপুর জেলায়। এ জেলার ১৩ উপজেলার সবগুলোই বন্যাকবলিত।

অপরদিকে টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যমুনার নলীন পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২৬ ও কালিহাতীর যোগাচর পয়েন্টে ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের নওগাঁ-জসিহাটি ঝিনাই নদীর বাঁধ ভেঙে অন্তত ২০ গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যাজনিত কারণে গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ১০৭ জনের মৃত্যুর খবর বুধবার জানানো হয় মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে। অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, বন্যায় গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের এবং ৪৮ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা ২৪। বন্যায় মারা যাওয়া ১০৭ জনের মধ্যে ৯২ জনেরই মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। আর সাপে কাটায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের, বজ পাতে মারা গেছেন দুজন। এছাড়া অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। বন্যাদুর্গত জেলাগুলোর মধ্যে জামালপুরে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে জানান আবুল কালাম। এ জেলায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়া সিরাজগঞ্জে ২৩, কুড়িগ্রামে ১৯, গাইবান্ধায় ১১, দিনাজপুরে সাত, লালমনিরহাটে ছয়, নীলফামারীতে পাঁচ ও কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছেন। বন্যায় আক্রান্ত ২১ জেলায় এক হাজার ৮২৪টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক।

জানা গেছে, টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়ার পর পানি কমতে শুরু করেছে উত্তরাঞ্চলের প্রধান দুই নদী তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রে। একে ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ’ বলছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন।

তবে পানি বাড়ছে গঙ্গা অববাহিকার নদীগুলোয়, যা মধ্যাঞ্চলে বন্যার বার্তা দিচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল সকালে জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে তা এখনও বিপৎসীমার তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।

ব্রহ্মপুত্রের পানি আট সেন্টিমিটার কমেছে কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে। তবে তা এখনও বিপৎসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার ওপরে। ফুলছড়ি পয়েন্টে পানি স্থিতিশীল। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে এখনও বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।

এ অবস্থায় গতকাল বন্যায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে যাতে ত্রাণ পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে গেলে তাকে এ আহ্বান জানান রাষ্ট্রপ্রধান।

সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি রাষ্ট্রপ্রধানকে জানান বলে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান। তিনি বলেন, ‘সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী দেশের বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন।’

সে সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি বন্যার্তদের কষ্ট লাঘবে প্রশাসনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ত্রাণসামগ্রী যাতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানা গেছে, এ পর্যন্ত দেশে বন্যায় মোট ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর।

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এক হাজার ৫৯৯টি। এগুলোয় আশ্রয় নেওয়াদের সংখ্যা চার লাখ ১১ হাজার। ৯ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজার ২৫৫ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে। নগদ দেওয়া হয়েছে প্রায় এক কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং ১৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে।