শেয়ার বিজ ডেস্ক : সস্তা শ্রমশক্তি কাজে লাগাতে চীনের বস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উত্তর কোরিয়ার কারখানায় পোশাক তৈরি করছে। এসব পোশাক বিশ্ববাজারে ‘মেইড ইন চায়না’ নামে রফতানি হচ্ছে। চীনের সীমান্তবর্তী উত্তর কোরিয়ার দানদং শহরের একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সস্তায় পোশাক তৈরি করতেই উত্তর কোরিয়াকে ব্যবহার করছে চীন। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে উত্তর কোরিয়ার দরজা বন্ধ হলেও পরোক্ষভাবে সম্ভবত এ দরজা খোলা থাকছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখায় শাস্তিমূলক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে জাতিসংঘ, যদিও বস্ত্রপণ্য রফতানি এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে রয়েছে।
সীমান্ত শহর দানদংয়ে চীন-কোরীয় যৌথ ব্যবসায়ীদের এ ধরনের বাণিজ্য প্রবণতা বাড়ছে। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শহরের এক চীন-কোরীয় ব্যবসায়ী জানান, ‘আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রয়াদেশ পাই।’ তিনি জানান, কয়েক ডজন পোশাক কোম্পানি এজেন্টরা দানদংয়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এসব পোশাক চীনের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা ও রাশিয়ায় বিক্রি হয়।
ওই ব্যবসায়ী বলেন, এতে করে পোশাক কোথায় প্রস্তুত হচ্ছে, চূড়ান্তভাবে ক্রেতা তা জানতেই পারছেন না। এটি খুবই সংবেদনশীল।
উত্তর কোরিয়ায় উৎপাদিত অস্ট্রেলিয়ার স্পোর্টসওয়্যার কোম্পানি রিপ কার্লের কিছু পণ্যে ‘মেইড ইন চায়না’ লেবেল খুঁজে পাওয়ায় গত বছর প্রতিষ্ঠানটি দুঃখ প্রকাশ করেছে। রিপ কার্ল অননুমোদিত একটি সাব-কন্ট্রাকটরকে এর জন্য দোষারোপ করেছে। তবে দানদংয়ের ব্যবসায়ী ও এজেন্টরা বলছেন, এটা অহরহ হচ্ছে।
পিয়ংইয়ংয়ে বসবাসকারী চীনের এক ব্যবসায়ী জানান, উত্তর কোরিয়ায় পোশাক প্রস্তুত করে প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কম হয়। এ কারণেই এতে অনেকেই জরিয়ে আছে।
উত্তর কোরিয়ায় বিদেশি কোম্পানিকে ব্যবসা করতে সাহায্যকারী নেদারল্যান্ডসের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জিপিআই জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ায় ১৫টি বড় আকারের পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের বিভিন্ন শহরে এসব প্রতিষ্ঠানের পোশাক কারখানা রয়েছে। এছাড়া কয়েক ডজন মধ্যম আকারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশটিতে।
কোরিয়া ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন এজেন্সির (কেওটিআরএ) তথ্যমতে, কয়লা ও অন্য খনিজ পদার্থের পরে গত বছর উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত ছিল বস্ত্র। ওই সময়ে মোট ৭৫২ মিলিয়ন ডলারের বস্ত্রপণ্য রফতানি করেছে দেশটি। সামগ্রিক রফতানি গত বছর চার দশমিক ছয় শতাংশ বেড়ে গত বছর দুই দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
চলতি মাসের শুরুতে সর্বশেষ দেওয়া জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞায় কয়লা রফতানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে কঠোর হওয়ার জন্য চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাপের চাপ থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের প্রথমার্ধে উত্তর কোরিয়ায় রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এ সময়ে চীন দেশটিতে এক দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। বস্ত্র উপকরণ অন্যান্য প্রথাগত শ্রম-নিবিড় পণ্য এ রফতানিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে এসব পণ্য জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই বলেই দাবি করছে চীনের শুল্ক বিভাগ।
শুল্ক কর্মকর্তা হুয়াং সংপিং বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বাণিজ্য হয়েছে। এতে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা পণ্য ছিল না।
উত্তর কোরিয়ার পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বস্ত্র ও অন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো।
তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনে বা প্রথম ছয় মাসে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য হয়েছে দুই দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় রফতানি হয়েছে এক দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ২৯ দশমিক সাত শতাংশ বেশি। তবে ওই সময়ে উত্তর কোরিয়া থেকে আমদানি ১৩ দশমিক দুই শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৮০ মিলিয়ন ডলারে।
সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, এর প্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ।
চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার লাভজনক কয়লা বাণিজ্যও নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। আরোপিত বাণিজ্যিক এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে চীন। উত্তর কোরিয়া থেকে কয়লার সব ধরনের আমদানি স্থগিত করে দেশটি। শুধু কয়লাই নয়, একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় তামা, নিকেল, রুপা, দস্তা ও মূর্তি বাণিজ্য।
উত্তর কোরিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত চীনের সঙ্গে এ নিষেধাজ্ঞায় এই পণ্যগুলো বিক্রির জন্য বিকল্প বাজার সন্ধান করতে হবে উত্তর কোরিয়াকে। তবে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাচ্ছে কয়লা বাণিজ্যে। চীন কয়লা না নিলে দেশটির মোট কয়লা উৎপাদনের ৬০ ভাগ বন্ধ করে দিতে হবে।
চীন অবশ্য এর আগে বেশ কয়েকবার উত্তর কোরিয়াকে শান্ত থাকতে বলেছিল। কিন্তু তার পরও সেপ্টেম্বর মাসে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে তা প্রচার করে উত্তর কোরিয়া। এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের এই নিষেধাজ্ঞা বেশ সহজেই মেনে নেয় চীন।
উল্লেখ্য, পরমাণু অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর কারণে ২০০৬ সাল থেকে উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে জাতিসংঘ। এরপর বিভিন্ন সময় সেই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানো হয়। নিষেধাজ্ঞার পরিধিও বাড়ে সময় সময়।