Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 7:22 pm

উদাসীনতা-অবহেলায় অগ্নিকাণ্ড ৯ শর্তে রপ্তানির অনুমতি

রহমত রহমান: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের জন্য কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। বিশেষ করে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণের শর্ত পালন করা হয়নি। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সংরক্ষণে কনটেইনারের ভেতর তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বিপজ্জনক এমন রাসায়নিক দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখাও অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী। কর্তৃপক্ষ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের যেসব শর্তে লাইসেন্স নিয়েছে, তার কোনোটাই পালন করেনি বলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অপরদিকে অগ্নিকাণ্ডের সাড়ে চার মাস পর ৯ শর্তে বিএম কনটেইনার ডিপোকে পোশাক রপ্তানির সাময়িক অনুমতি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। পোশাক ছাড়া বিপজ্জনক পণ্য ও রাসায়নিক জাতীয় পণ্য হ্যান্ডেলিং বন্ধ থাকবে। সম্প্রতি এই অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনুমতির শর্ত পরিপালন না করলে তিন মাস পর অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান সই করা অনুমতিপত্র দেয়া হয়। যাতে বলা হয়, ৪ জুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি অফডক বিএম কন্টেইনার ডিপো লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে বহু মানুষ নিহত, দগ্ধ ও আহত হয়। এছাড়া আমদানি-রপ্তানির জন্য অফডকে থাকা বহু কন্টেইনার ক্ষতিগ্রস্থ এবং শেড, অফিস বিল্ডিংসহ সরঞ্জামাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরই প্রেক্ষিতে ৫ জুন কাস্টম হাউস পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বিএম কনটেইনারে আমদানি-রপ্তানি স্থগিত করে। কনটেইনার ডিপো পুনরায় চালু করে ২৯ আগস্ট ও ১১ সেপ্টেম্বর ডিপো কর্তৃপক্ষ কাস্টমসকে চিঠি দেয়।

যাতে বলা হয়, অফডক পরিচালনার সকল লাইসেন্স বিশেষ করে ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস দুই দিনব্যাপী অগ্নি নির্বাপন কর্মশালা করেছে। অফডকে স্থাপনা নিমার্ণ করা হচ্ছে। সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। ডেঞ্জারাস গুডস ব্যবস্থাপনার জন্য ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস (আইএমডিজি) কোডের নীতিমালা মেনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হবে। এছাড়া অগ্নি ও অন্যান্য নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার বিবরণ দেয়া হয় চিঠিতে। অপরদিকে, কাস্টম হাউসের চিঠিতে রপ্তানি চালু করতে নয়টি শর্ত দেয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছেÑবন্দরের অনাপত্তি, ডিপো-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের নীতিমালা প্রতিপালন, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার নীতিমালা বাস্তবায়ন, সময়মত কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট স্থাপন, সিসি টিভি স্থাপন ও ব্যাকআপ রাখা, অফডক পরিচালনায় নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করা ও তাতে কাস্টমসকে অ্যাকসেস দেয়া। শর্তগুলো প্রতিপালন করা না হলে তিন মাস পর এই অনুমোদন বাতিল হয়ে যাবে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।

অপরদিকে, এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেয়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের পরদিন (৫ জুন) চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস তদন্ত কমিটি গঠন করে। সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে বের করতে এই কমিটি করা হয়। কমিটি ১৭ আগস্ট কমিশনারের নিকট ১৭ পাতার প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ১০টি পর্যবেক্ষণ ও ১৭টি সুপারিশ করা হয়। এছাড়া ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেডকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। যাতে শর্ত না মানায় কেন বিএম কনটেইনার ডিপোর লাইসেন্স বাতিল করা হবে না, তা লিখিত আকারে জানাতে ৩০ দিন সময় দেয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপোয় কনটেইনারে অননুমোদিত জেরিক্যানে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাপ ও তাপে জেরিক্যান ফেটে গিয়ে প্রথমে ধোঁয়া ও পরবর্তী সময় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এ ধরনের বিপজ্জনক পণ্য দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে রোদে ফেলে রাখলে আগুন লাগার আশঙ্কা থাকে। বিষয়ে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড অবগত ছিল। ব্যবহƒত জেরিক্যান নিন্মমানের ও তাপ অপ্রতিরোধী হওয়ায় বাইরের তাপকে প্রতিরোধ করতে পারেনি, যা অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের মূল কারণ। কিন্তু সিসি টিভির ফুটেজ না পাওয়ায় কোনো কনটেইনার থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে, তা কমিটি চিহ্নিত করতে পারেনি। এই ঝুঁকির বিষয়ে কাস্টমসকে অবহিত করা হয়নি। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিষয়ে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড কোনো সর্তকতা দেয়নি। এক্ষেত্রে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অসর্তকতা ও উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। অফডক কর্তৃপক্ষও বিষয়টি কাস্টমসকে জানায়নি।

আরো বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডে কনটেইনারে রক্ষিত আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে বিএম কনটেইনারের সফটওয়্যারে কাস্টমসের এক্সেস না থাকায় কী পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে-তা নিরূপণ করা যায়নি। বিএম কনটেইনার কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ এই পণ্য সংরক্ষণে আইএমডিজি কোড পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে। বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণে বিএম কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সের কোন শর্ত পরিপালন করেনি। কনটেইনার ডিপো হাইড্রোজেন পারক্সাইডের মতো দাহ্য রাসায়নিকের হ্যান্ডলিং এবং কনটেইনার সংরক্ষণের বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস নীতি অনুসরণ করেনি। আগুনের ঘটনায় যে রাসায়নিক পণ্যের উপস্থিতি দায়ী সে সম্পর্কেও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঠিক তথ্য দেয়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি, ডিপোয় পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটি সিস্টেম এবং ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না। ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটিস (আইএসপিএস) অনুসারে এটিতে ফাস্ট-এইড চিকিৎসা সুবিধা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থারও অভাব ছিল। লাইসেন্সের শর্ত পরিপালন না করায় প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের জন্য বিএম কনটেইনার কর্তৃপক্ষের পদে পদে অনিয়ম ছিল। লাইসেন্সের শর্ত মানা হয়নি। তদারকির দায়িত্বে থাকা কোন কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে তদারকি করেনি। এখন কর্তৃপক্ষ সব শর্ত মেনে ডিপো চালু করতে চায়। সেজন্য আবেদন করেছে। কাস্টম হাউস থেকে সব বিবেচনা করে রপ্তানিতে সাময়িক অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। সঠিকভাবে নিয়ম পালন না করলে অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে। কাস্টম হাউস থেকে কঠোর তদারকি করা হবে।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগে বিএম কনটেইনার ডিপো চালু হয়। এতে বিনিয়োগে পরিমাণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এই ডিপোর চেয়ারম্যান নেদারল্যান্ডসের নাগরিক রবার্ট প্রঙ্ক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরিচালক হিসেবে আছেন স্মার্ট জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। এই ডিপোয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৯০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা করা হয়। চট্টগ্রামের শীর্ষ পাঁচটি বড় আইসিডির মধ্যে অন্যতম বিএম কন্টেইনারে ৪ জুন রাতে ডিপোয় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক ব্যক্তি।