নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের তথ্যের সঙ্গে ব্যাপক গরমিল ছিল। অবশেষে প্রকৃত রপ্তানি আয়ের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সদ্যবিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মতো গরমিল পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে ওই গলদ প্রমাণিত হওয়ার পর রপ্তানি থেকে ওই আয় বাদ দেয়া হয়েছে।
এতে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে হিসাব এলোমেলো হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগের প্রতিবেদনে গত মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত বজায় থাকলেও এপ্রিল মাসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, একই সময় পর্যন্ত চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি বজায় ছিল। আর এপ্রিলে এসে সেই ঘাটতি আরও বেড়েছে। অন্যদিকে আগের প্রতিবেদনে আর্থিক হিসাবে মার্চ পর্যন্ত বড় ঘাটতি বজায় থাকলেও এপ্রিল মাসের প্রতিবেদনে একই সময়ে উল্টো কিছুটা উদ্বৃত্ত দেখা যায়। আর এপ্রিলে এসে সেই উদ্বৃত্ত বেশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য হিসাবে হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আগের অর্থবছরে হঠাৎ করে চলতি হিসাব পজিটিভ ও আর্থিক হিসাব নেগেভিভ হয়ে যায়। যখন চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত ও আর্থিক হিসাব ঘাটতি দেখা গেল এবং বারবার চলতি ও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি বাড়তে থাকল, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এর প্রকৃত কারণ জানার উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ইপিবি মিলে এর কারণ খোঁজা শুরু হয়। এরপরই দেখা গেল বিভিন্ন সময় একই এক্সপোর্ট বিলের ক্ষেত্রে মাল্টিপল এন্ট্রি করা হয়েছে। এ কারণে প্রকৃত রপ্তানি আয় ও প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের মধ্যেও গরমিল হয়ে আসছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক মাল্টিপল এন্ট্রি হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে নিশ্চিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইপিবির রপ্তানি আয় ও প্রকৃত রপ্তানি আয়ের মধ্যে যে গরমিল হচ্ছিল, সেটা বাদ দিয়েছে, যে কারণে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হিসাবেও বড় পরিবর্তন এসেছে।
নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য রপ্তানির বিপরীতে দেশে যে পরিমাণ অর্থ আসার কথা, অনেক ক্ষেত্রেই তার ব্যত্যয়ও ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বন্দর থেকে পণ্য রপ্তানির পরপরই তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশ বোর্ডে রিপোর্ট করতে হয়। রিপোর্টিংয়ের ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি মূল্য দেশে আনার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই ওই সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাশিত না হওয়ার নজির রয়েছে। অন্যদিকে ইপিবি এনবিআরের অ্যাসাইকোডা থেকে রপ্তানি আয়ের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। ফলে ইপিবির রপ্তানি তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের তথ্যে দীর্ঘদিন ধরের গরমিল চলে আসছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই দুই সংস্থার রপ্তানির তথ্যের মধ্যে ৯২৪ কোটি ডলারের গরমিল ছিল। আবার ওই অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে চলতি হিসাবে হঠাৎ বড় উদ্বৃত্ত ও আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই গরমিলের কারণ খোঁজার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ বিষয়ে গত ২০ ডিসেম্বর ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ওই বৈঠকে ইপিবির রপ্তানি তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে গরমিল হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলোÑবাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূল্য পরিশোধ ভিত্তিতে রপ্তানি তথ্য সংকলন করে। কিন্তু ইপিবি এনবিআর ও কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড থেকে অপরিপক্ব তথ্য সংকলন করে। ফলে হিসাবে তারতম্য হয়। ইপিজেডের বাইরে রপ্তানিমুখী কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে কাঁচামাল বিক্রি হলে তা কাস্টমসের অ্যাসাইকোডাতে স্থানীয় রপ্তানি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তা থেকে পণ্য উৎপাদনের পর রপ্তানি হলে অ্যাসাইকুডায় পুনঃরপ্তানি হিসেবে ধরা হয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি ডাবল এন্ট্রি হয়। এনবিআর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) থেকে কোনো পণ্য স্থানীয়ভাবে বিক্রি হলে তাকে রপ্তানি হিসেবে গণ্য করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তা করে না। বাংলাদেশ ব্যাংক শর্ট শিপমেন্ট সমন্বয় করে। এনবিআর ও ইপিবি শর্ট শিপমেন্ট সমন্বয় করে না। আবার একই ইনভয়েসের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন এইচএস কোডে একই মূল্যমানের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিল অব এক্সপোর্ট হওয়ার পর অনেক সময় পণ্য জাহাজীকরণ হয় না, যা এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব থেকে তা বাদ দেয়া হয় না। অনেক সময় যে পরিমাণ পণ্যের মূল্য রপ্তানি হয়, সেই পরিমাণ ডলার প্রত্যাবাসিত হয় না।
রপ্তানি আয়ে বড় গলদ: গতকাল বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য হিসাবের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের প্রকৃত আয় হয়েছে তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কম। আগের মাস মার্চ পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে প্রকৃত রপ্তানি আয় হয়েছিল তিন হাজার ৯৪ কোটি ডলার। অথচ ইপিবির তথ্যের ভিত্তিতে মার্চ মাস পর্যন্ত তথ্য দিয়ে করা আগের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি আয় হয়েছিল চার হাজার ৮৭ কোটি ডলার। ফলে আগের প্রতিবেদনে সঙ্গে নতুন প্রতিবেদনে মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি আয়ে গরমিল ধরা পড়ে প্রায় ৯৯৩ কোটি ডলার। আর এপ্রিলে সেই গরমিল বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৮০ কোটি ডলার। কারণ নতুন প্রতিবেদনে এপ্রিল পর্যন্ত প্রকৃত রপ্তানি আয় হয়েছে তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার, যা ইপিবির হিসাবে ছিল চার হাজার ৭৪৭ কোটি ডলার।
বাণিজ্য ঘাটতিতে বড় লাফ: কড়াকড়িসহ নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমে আসা ও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসছিল। তবে রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে বড় গলদ ধরা পড়ার পর বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। আগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসের হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল মাত্র ৪৭৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। তবে নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, একই সময় পর্যন্ত বাণিজ্য ঘাটতি দেখা যাচ্ছে এক হাজার ৫৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সেই ঘাটতি এপ্রিলে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৮৭০ কোটি ডলার।
উদ্বৃত্ত থেকে বড় ঘাটতিতে চলতি হিসাব: আগের প্রতিবেদনে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৫৭৯ কোটি ৯০ লাখ ডলারের বড় উদ্বৃত্ত বজায় ছিল। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, আমদানি ব্যয় কমে আসা এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। তবে নতুন প্রতিবেদনে রপ্তানি আয় থেকে গরমিলের তথ্য বাদ দেয়ায় মার্চ পর্যন্ত তথ্যেই চলতি হিসাব উল্টো বড় ঘাটতি দেখা যায়, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এপ্রিল মাস পর্যন্ত সেই ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৫৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর আগের অর্থবছরের পুরো সময়ে সেই ঘাটতি ছিল ২৬৬ কোটি ডলার।
ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে আর্থিক হিসাব: আর্থিক হিসাবে বিদেশি ঋণ ও সহায়তা, এফডিআই, পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্ট প্রভৃতি বিষয় থাকে। আগের প্রতিবেনে গত মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে আর্থিক হিসাবে রেকর্ড ৯২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি দেখা যায়। তবে নতুন প্রতিবেদনে একই সময় পর্যন্ত আর্থিক হিসাবে উল্টো ৬৫ কোটি ৩০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। আর এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসের হিসাবে সেই উদ্বৃত্ত বেড়ে হয়েছে ২২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছর শেষেও আর্থিক হিসাবে ৩৫৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত বজায় ছিল। অথচ আগের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, আর্থিক হিসাবে ওই অর্থবছর শেষে ২০৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল। আর্থিক হিসাবে ঘাটতির কারণ হিসেবে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়া, নতুন ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করে আসছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতিও বেড়েছে: আর্থিক হিসাবে উন্নতি হওয়ার পরও এক মাসের ব্যবধানে সার্বিক ভারসাম্যে কিছুটা অবনতি হয়েছে। নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি ছিল ৪৭৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেটি এপ্রিলে বেড়ে হয়েছে ৫৫৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আগের প্রতিবেদনেও মার্চ পর্যন্ত সার্বিক ভারসাম্যে ৪৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে ৮২২ কোটি ডলারের বেশি ঘাটতি ছিল।