Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 1:08 am

উদ্বেগ গম উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে

দেশে গম উৎপাদনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার যে সংবাদ গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশ হয়েছে, নানা কারণে সেটি আমাদের জন্য উদ্বেগের। অনেকের হয়তো মনে আছে, কয়েক মাস আগে শেয়ার বিজেই একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, গত ষোলো বছরে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এক-চতুর্থাংশ। স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের কারণে এ সময়ে দেশে গমের চাহিদা আগের তুলনায় বেড়েছে ৭ গুণ। কিন্তু উল্লিখিত সময়ে দেশে শস্যটির উৎপাদন কমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশ। এ অবস্থায় রোগ ও প্রাকৃতিক কারণে ফসলটির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা যদি পূরণ না হয়, সেটা আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ নিঃসন্দেহে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার দেশে গম উৎপাদন কমে আসার কারণ মূলত দুটি। এক. স্বল্পমেয়াদি শীত ও দুই. ব্লাস্ট রোগ। বস্তুত শীতের স্বল্পস্থায়িত্ব যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, তা এখন কারও অজানা নয়। এর অভিঘাতে বাংলাদেশ যে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে সতর্কবাণী রয়েছে অনেক আগে থেকে। সরকারও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। কৃষিবিদদেরই পর্যবেক্ষণ হলো, অন্যান্য ফসলের আধুনিক জাত উদ্ভাবনে যেমন সফলতা লক্ষ করা গেছে, গমের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। প্রশ্নটি স্বভাবতই ওঠে, নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাচ্ছেন কেন? রোগ প্রতিরোধে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও স্থানীয় আবহাওয়ার বর্তমান গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে ফসলটির নতুন জাত উদ্ভাবন কি অসম্ভব? এটা করা গেলে গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যে নতুন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে, তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে হয়।

প্রসঙ্গত, নীতিনির্ধারকদের আমরা একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। উৎপাদন কমার কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা স্বভাবতই গম চাষে নিরুৎসাহী হবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা যদি হ্রাস না পায়, তাহলে এর দাম বাড়বে। তখন বাজারে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই বাড়াতে হবে আমদানি। সেজন্য আবার বেড়ে উঠবে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়। কথা হলো, যে শস্যটি দেশে ব্যবহার হচ্ছে মানুষের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হিসেবে, যার চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, অব্যাহতভাবে তাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো কি উচিত হবে? এর কারণে মূল্যস্ফীতি হলে মানুষ সে চাপ সামলাবে কীভাবে?

এর সঙ্গে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্নটিও যুক্ত। চাল উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এক্ষেত্রে নিকট অতীতে প্রবৃদ্ধি খুব একটা অর্জন করা যায়নি। গম উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রধান এ দুই খাদ্যশস্যের দামে বড় ধরনের প্রভাব হয়তো ফেলেনি, কিন্তু এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখালে ভবিষ্যতে নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে। এজন্য আমরা মনে করি, শুধু গম উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া কিংবা আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির কারণেই নয় বিষয়টিকে দেখা উচিত অভ্যন্তরীণ বাজার পরিস্থিতি ও খাদ্যনিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে। এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, গম থেকে উৎপাদিত খাদ্যের দাম বাড়লে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে জনস্বাস্থ্যে। পশু খাদ্য ও পোলট্রি ফিড তৈরিতেও গম ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এগুলোর দাম বৃদ্ধি হলে তাও নানাভাবে প্রভাব ফেলবে বাজারে। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু উপযুক্ত নীতিপরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে অতীতে সরকারের অনেক পরিকল্পনা আমরা দেখেছি। এখন খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্যটির বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা চাই।