ইসমাইল আলী : বাধাহীনভাবে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতেই সাধারণত নির্মাণ করা হয় ফ্লাইওভার। এজন্য ফ্লাইওভারে কোনো মোড় থাকে না। তাই ফ্লাইওভারের ওপর সিগন্যাল বাতিও বসানোর প্রশ্ন আসে না। যদিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। এর মৌচাক ও মালিবাগ পয়েন্টে ফ্লাইওভারের ওপরেই রয়েছে তিন রাস্তার মোড়। এজন্য দুই পয়েন্টে বসানো হয়েছে ছয়টি সিগন্যাল বাতি।
মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ অংশ হলো রামপুরা-মৌচাক-শান্তিনগর। কারণ এ অংশের দুই পয়েন্টে রয়েছে তিন রাস্তার মোড়। আগামী ১৫ অক্টোবর এ অংশটি উদ্বোধন করা হবে। এর আগে নকশায় ত্রুটি নিয়েই ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ খুলে দেওয়া হয় ফ্লাইওভারটির সাতরাস্তা-হলি ফ্যামিলি অংশ। আর গত বছর সেপ্টেম্বরে এর বাংলামোটর-মৌচাক অংশ চালু করা হয়।
ফ্লাইওভারটিতে ঘুরে দেখা যায়, রামপুরা থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর ও রাজারবাগ অংশের নির্মাণ শেষ হয়ে গেছে। এর তিনতলা অংশটি রামপুরা রোড থেকে মৌচাক হয়ে একটি র্যাম্প শান্তিনগর গিয়ে শেষ হয়েছে। অপরটি গিয়ে নেমেছে রাজারবাগ। আর বাংলামোটর থেকে মগবাজার, মৌচাক দিয়েও দুই র্যাম্পে বিভক্ত হয়েছে ফ্লাইওভারটি। এর একটি মৌচাক, মালিবাগ হয়ে রাজারবাগ পুলিশলাইনসের কাছে শেষ হয়েছে। আরেকটি মালিবাগ থেকে শান্তিনগর গিয়ে শেষ হয়েছে। এতে মৌচাক ও মালিবাগ দুই মোড়েই ফ্লাইওভারের ওপরে তিন রাস্তার মোড় তৈরি হয়েছে।
উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভার দিয়ে বাংলামোটর থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর যেতে চাইলে মৌচাক ও মালিবাগ দুই পয়েন্ট অতিক্রম করতে হবে যানবাহনকে। আবার রাজারবাগ থেকে রামপুরা যেতে হলেও ফ্লাইওভারে পেরোতে হবে মৌচাক ও মালিবাগ মোড়। এতে মৌচাক ও মালিবাগে বিদ্যমান সড়কের দুটি তিন রাস্তার মোড় ফ্লাইওভারের ওপরেও থাকছে। এজন্য দুই পয়েন্টে বসানো হয়েছে সিগন্যাল বাতি। এতে ফ্লাইওভারের ওপরেও যানজট সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ফ্লাইওভারের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে একটি অংশ অপরটির সঙ্গে মিলে গেছে। এতে দুটি মোড় তৈরি হয়েছে। আর তিন বছর লাগল এ ভুল বুঝতে। এজন্য মোড় দুটিতে সিগন্যাল পদ্ধতি রাখা হয়েছে, যা উড়ালসড়কের ওপরেই যানজট সৃষ্টির কারণ হবে।
যদিও মাত্র একটি অংশ সংশোধন করলেই এ ঝামেলা থাকত না বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, বাংলামোটর থেকে যে অংশটি মৌচাক এসে মোড় তৈরি করেছে, তা ওপরে তুলে তিনতলা অংশের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই হতো। এতে মালিবাগ ও মৌচাকে কোনো মোড় পড়ত না। বাধাহীনভাবে মালিবাগ ও মৌচাক মোড়ে যানবাহন চলাচল করতে পারত।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সব ধরনের মোটর যান ডান হাতে চালিত। সে বিষয় বিবেচনায় রেখে নির্মাণ করা হয় সড়ক অবকাঠামো। নকশাও প্রণয়ন করা হয় সে আদলেই। তবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটি বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে নকশা করা। সেভাবেই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ওঠার রাস্তা অনেক বেশি খাড়া হয়ে গেছে। আর নামার অংশটি অনেক বেশি প্রসারিত। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে ডানে মোড় নেওয়ার ব্যবস্থাও নেই। এতে ফ্লাইওভারের আশানুরূপ সুবিধা মিলবে না বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে দুটি পয়েন্টে ডানে মোড় নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর এ দুই পয়েন্টেই তিন রাস্তার মোড় তৈরি হয়ে গেছে। এছাড়া ফ্লাইওভারটির কারওয়ান বাজার এলাকার র্যাম্পটিকে ১৫০ মিটার বর্ধিত করা হয়। এতে রেললাইন পেরিয়ে শেষ হয়েছে র্যাম্পটি। অথচ সোনারগাঁও হোটেলের পাশে সড়কটি অনেক সরু। তাই এ সড়কে নিয়মিতই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
ড. সামছুল হক বলেন, সাধারণত সিগন্যাল ও যানজটের ঝামেলা এড়িয়ে ডান দিকের রাস্তায় যাওয়ার সুবিধা করতেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার এর উদাহরণ। কিন্তু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকায় ডানে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এতে ফ্লাইওভারটি যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে না। বরং খাড়া লুপ দিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে ফিটনেসবিহীন ও ওভারলোডেড বাস-ট্রাক।
তথ্যমতে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা ত্রুটির বিষয়টি প্রথম চিহ্নিত করে বুয়েট। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একাংশ উদ্বোধনের পর দিনই গত ৩১ মার্চ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ত্রুটি খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। যদিও ওই কমিটি কোনো প্রতিবেদন এখনও জমা দেয়নি।
এদিকে উদ্বোধনের পর থেকেই ফ্লাইওভারে ওঠানামার মুখে যানজট সৃষ্টি হয়। বিশেষত সকালে ও সন্ধ্যায় এ যানজট অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া ফ্লাইওভারটিতে যানবাহন ওঠানামায় সমস্যা রয়েছে। এতে উদ্বোধনের পর দুবার দুর্ঘটনা ঘটেছে ফ্লাইওভারটি। নামার সময় একবার উল্টে গেছে বাস ও আরেকবার প্রিজন ভ্যান। এতে কয়েকজন আহত হন।
নকশায় ত্রুটির বিষয়গুলো কীভাবে ধরা পড়ল জানতে চাইলে অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, নির্মাণকাজের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) লোকজন বুয়েটে এসেছিলেন। ফ্লাইওভারের ডেক (মেঝে) স্থাপনে হিসাবের গরমিল নিয়ে এসেছিলেন তারা। সেটার সমাধান করেছিল বুয়েট। তখনই নকশার বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে যে অভিযোগ আসছিল, তারও সত্যতা পাওয়া যায়। তবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ যে পর্যায়ে এসব ত্রুটি ধরা পড়ে, তা থেকে উত্তরণ প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।
জানতে চাইলে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়নকালীন প্রকল্প পরিচালক ও এলজিইডির সাবেক তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী হায়দার আলী বলেন, ঢাকা শহর এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে ব্যাকরণ মেনে এখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা সম্ভব নয়। মগবাজার-মৌচাক এলাকার সড়ক খুবই কম প্রশস্ত। তবে কিছুটা ছাড় না দিলে ওই এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণই সম্ভব হতো না। তাই কিছু জটিলতা এতে রয়ে গেছে। তবে এগুলো খুব বেশি সমস্যা তৈরি করবে না।