ইসমাইল আলী: গত দুই দশকে বাংলাদেশে ব্যবসার বেশ কিছু ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন উদ্যোক্তা সমাজও। এ দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের বড় একটা অংশ মনে করে নতুন ব্যবসা স্থাপনে বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। চাকরির পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়া পেশা হিসেবে বেশ আকর্ষণীয় তাদের কাছে। তবে বাংলাদেশের বিনিয়োগচিত্র মোটেও সুখকর নয়। ফলে দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (জিইডিআই) বৈশ্বিক উদ্যোক্তা সূচক-২০১৮তে এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, উদ্যোক্তা তৈরিতে গত বছরের চেয়ে এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। আর দুই বছরে পিছিয়েছে অনেকটা।
উদ্যোক্তা সূচক বলছে, বিশ্বের ১৩৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৪। গত বছর এ স্থান ছিল ১৩৩। যদিও দুই বছর আগে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। আর এ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০’র মধ্যে পেয়েছে ১১ দশমিক ৮০। দুই বছর আগে এটি ছিল ১৫ দশমিক ২০।
সূচকটিতে বাংলাদেশের পেছনে আছে বুরুন্ডি, মৌরিতানিয়া ও চাদ। দেশ তিনটির অবস্থান যথাক্রমে ১৩৫, ১৩৬ ও ১৩৭। এদের স্কোর যথাক্রমে ১১ দশমিক ৮০, ১০ দশমিক ৯০ ও ৯। আর বাংলাদেশের ওপরে আছে মালাউই (১৩৩), সিয়েরা লিওন (১৩২), উগান্ডা (১৩১)। দেশ তিনটির স্কোর যথাক্রমে ১২ দশমিক ২০, ১২ দশমিক ৩০ ও ১২ দশমিক ৯০।
প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘উদ্যোক্তা সূচকে ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ যে ১৩৪তম, সেটা খুবই উদ্বেগজনক। তবে নতুন উদ্যোক্তা যে দেশে একদমই তৈরি হচ্ছে না, তেমনটি নয়। কিন্তু যে গতিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে, তা অনেকটা মন্থর। এজন্য সরকার ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, উদ্যোক্তা সূচকটি তৈরি করা হয়েছে ঝুঁকি মোকাবিলা, পণ্য উদ্ভাবন, নতুন ব্যবসা শুরু করার দক্ষতা, মানবসম্পদ, উচ্চ প্রবৃদ্ধি, ঝুঁকি মূলধন (রিস্ক ক্যাপিটাল), নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রতিযোগিতা, সুযোগ কাজে লাগানোর মতো ১৪টি ক্ষেত্রে সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে। আর এসব সক্ষমতাকে তিনটি বিভাগের আওতায় ফেলা হয়েছে। এগুলো হলোÑউদ্যোক্তার মনোভাব, উদ্যোক্তার দক্ষতা ও উদ্যোক্তার আকাক্সক্ষা।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বৈশ্বিক উদ্যোক্তা সূচকে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির স্কোর যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৬০। শীর্ষ পাঁচে এরপর রয়েছে সুইজারল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। দেশগুলো স্কোর যথাক্রমে ৮০ দশমিক ৪০, ৭৯ দশমিক ২০, ৭৭ দশমিক ৮০ ও ৭৫ দশমিক ৫০। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৮, শ্রীলঙ্কা ৯০ ও পাকিস্তান ১২০তম অবস্থানে। দেশগুলোর স্কোর যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৪০, ২১ দশমিক ৯০ ও ১৫ দশমিক ৬০।
বিডি ভেনচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত হোসেন বলেন, উদ্যোক্তা তৈরিতে এখনও বড় বাধা ভালো প্লাটফর্ম না থাকা। কেউ একটি বিষয়ে দক্ষতা নিয়ে বা প্রাথমিক কোনো বিষয় জেনে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করতে পারে। কিন্তু ভালো প্লাটফর্ম না থাকায় ব্যবসা পরিচালনা, বাজার বিশ্লেষণ, ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তাকে দক্ষ হতে সাহায্য করার কেউ থাকে না। এছাড়া পরিবার থেকে শিক্ষিত তরুণদের ব্যবসায় যেতে উৎসাহিত করা হয় না। এজন্য সামাজিক ও পারিবারিক স্বীকৃতির বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া অর্থায়ন প্রক্রিয়া সহজ করতে দেশে ভেনচার ক্যাপিটাল ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে পারলেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা সহজ হবে। এতে উদ্যোক্তারাও সাহস পাবে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা পরিচালনার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর বড় সমস্যা হলো উদ্যোক্তার মনোভাবে। বাকি দুটি ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের দেশগুলোর অবস্থান মোটামুটি কাছাকাছি। এজন্য এসব দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ উদ্যোক্তাবান্ধব করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ব্যবসার জন্য বা শুরুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব বেশি আকর্ষণীয় গন্তব্য নয়Ñএমন তথ্য উঠে এসেছে ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট ও গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্টেও। উভয় প্রতিবেদনে ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, প্রতিকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের অভাব, দুর্বল কর কাঠামো, সম্পত্তি হস্তান্তরে জটিলতা প্রভৃতি।
উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে নেতিবাচক মনোভাবের পেছনে এ বিষয়গুলো কাজ করে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সূচকগুলো নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করলেও দেশের সামগ্রিক পরিবেশ উদ্যোক্তা সৃষ্টির সহায়ক নয়। এক্ষেত্রে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা এখনো দূর করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি নীতির অভাবে অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখান না।