উদ্যোক্তা হতে চাইলে ঝুঁকি নিতে হবে

২১ জুলাই স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে ‘তরুণ উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নতুন উদ্যোক্তা ও আইডিয়া-বিষয়ক একটি প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় বক্তারা উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নানা সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পক্ষ থেকে এ কর্মশালাটির আয়োজন করা হয়। এতে বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত অতিথিদের উদ্যোক্তাবিষয়ক নানা প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থীরা। এ আয়োজনে গণমাধ্যম সহযোগী ছিল শেয়ার বিজ। কর্মশালায় উপস্থাপিত অভিমত সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ

আলোচক
অধ্যাপক মো. আলী নকি
উপাচার্য, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

রুবানা হক
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোহাম্মদী গ্রুপ

নাঈম জালাল উদ্দীন
সহকারী অধ্যাপক ও ক্যাম্পাস সমন্বয়ক

আমান আশরাফ ফাইজ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গাজী টেলিভিশন

নাছিমা আক্তার নিশা
প্রেসিডেন্ট, উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই)

সৈয়দ আলমাস কবির
প্রেসিডেন্ট, বেসিস

সৌরভ ইসলাম
কমিউনিটি ম্যানেজার, গুগল বিজনেস গ্রুপ

ইমরান ফাহাদ
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ইনোভেশন হাব বাংলাদেশ

রুবানা হক
নতুন আইডিয়া সৃষ্টি করতে হবে। সব সময় সত্য কথা বলতে হবে। আর নিজের সমালোচনা শোনার মানসিকতা থাকতে হবে। নিজের সমালোচনা শুনলে তা থেকে নিজেকে ঠিকভাবে তৈরি করা যায়। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। এখনকার কাজ অন্য সময়ের জন্য রেখে দেওয়া যাবে না। পরিশ্রম করে যেতে হবে, তা না হলে কোনো কিছুতে সফল হওয়া যাবে না।
জীবনে বিফলতা আসতেই পারে, কিন্তু সেটি চিরস্থায়ী নয়। তাই কখনও বিফল হলেও উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বদলের স্বপ্ন দেখতে হবে। আমি আমার স্বামীর ফ্যাক্টরি ফ্লোরে বসে কাপড় কেটেছি, স্যাম্পল নিয়ে বায়ারের কাছে ঘুরেছি, এখনও ঘুরছি। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জš§ নিয়েও আমি উদ্যোক্তা হতে পেরেছি নিজের চেষ্টায়। ছাত্রাবস্থা থেকেই আমি টিউশনি করেছি, পরিশ্রম করে এ অবস্থানে এসেছি। তোমরা সব সময় নিজের অতীতের দিকে তাকাবে। কোথা থেকে এসেছ, কীভাবে এসেছÑসেটা মনে রাখতে হবে। শিকড় ভুলে গেলে উন্নতি করা সম্ভব নয়।
একটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবেÑসবাই তোমাকে সাহস দেবে না, তোমার পাশে দাঁড়াবে না। অনেকেই হতাশ করবে, তোমার উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছাকে সমর্থন করবে না। অনেকে হয়তো সমালোচনা করবে যে, চাকরি না করে এসব কী করছে। এসবে কান দিলে চলবে না। মন কী বলে, সেটা শুনতে হবে। নিজের ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনটাকে ক্রিয়েটিভ করে তুলতে হবে। সে সঙ্গে বই পড়তে হবে, গবেষণাধর্মী আর্টিকেল। তাহলে জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হবে, চিন্তাশক্তি বাড়বে, ভালো আইডিয়া বের হবে।

অধ্যাপক মো. আলী নকি
ব্যবসা এক কথায় নতুন আইডিয়া। যে উদ্যোক্তা নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে পারবে, সে সফল হবে। কারণ মানুষ এখন নতুন কিছু চায়। নতুন কিছু পছন্দ করে।
বাসার ছাদে টবে গাছ লাগানো যেমন একটা আইডিয়া, তেমনি ছাদে মাছ চাষও একটা আইডিয়া। কিন্তু একই সঙ্গে মাছ চাষ ও গাছ পরিচর্যাÑএটা এক নতুন আইডিয়া। তাই উদ্যোক্তা হতে চাইলে একাধিক আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে। পার্থক্য বের করতে হবে। ভোক্তার জন্য কোনটা সঠিক, তা বুঝতে হবে। মানুষের উপকারের মধ্য দিয়ে নিজের অর্জন বের করে আনতে হবে।
বর্তমানে ব্যবসার ধরন পাল্টেছে। এখন ব্যবসার অনেক কিছুই বুদ্ধিমত্তা ও নতুন আইডিয়ার ওপর নির্ভর করে। উদ্যোক্তা হতে হলে ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। চাকরির লোভ ছেড়ে নিজেকে পরিশ্রমী হিসেবে তৈরি করতে হবে। আইডিয়া যত শক্তিশালী হবে, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনাটাও তত বেশি হয়। তাই সবকিছু বিশ্লেষণ করতে আইডিয়া তৈরি করতে হবে।

নাঈম জালাল উদ্দিন
নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে এমন একটি কর্মশালা খুবই কাজে দেবে বলে আমার বিশ্বাস। আশা করি, এমন কর্মশালা আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথ দেখাবে। শিক্ষার্থীদের বলব, শুধু চাকরির পেছনে দৌড়ালে চলবে না। কাউকে না কাউকে উদ্যোক্তা হতে হবে। চাকরির চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়া উত্তম। চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হতে পারলে তা সমাজে অনুকরণীয় হয়। ভোক্তা কী চান, সেটা একজন উদ্যোক্তাকে জানতে হবে। বুকভরা সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখতে হবে আর সে অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। জেগেও স্বপ্ন দেখতে হবে; আবার ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন না থাকলে জীবনে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়।
একজন উদ্যোক্তাকে অনেক গুণ অর্জন করতে হয়। তাকে ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে জানতে হবে, অ্যাকাউন্টিং সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে, মার্কেটিং তো অবশ্যই জানতে হবে। তা না হলে বাজার সম্পর্কে ধারণাই পাওয়া যাবে না। আইটিতে ভালো দখল থাকতে হবে। মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে, সেটা বজায় রাখতে হবে। কনজুমারের চাহিদাটা বুঝতে হবে, তাদের কাছে যেতে হবে। মানুষ কী চায়Ñসেটা খুঁজে বের করতে হবে। নতুন কোন জিনিসটার প্রতি মানুষের আগ্রহ জš§াতে পারে, সেটি বুঝতে হবে।
উদ্যোক্তা তৈরির পথে শিক্ষকরাও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। শিক্ষার্থীদের বদ্ধ করে রাখা চলবে না, অনেক সময় শিক্ষকরা মনে করেন তারা অনভিজ্ঞ, ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এ ধারণা ভুল। সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীরা ভালো কিছু করে দেখাতে পারে।

সৈয়দ আলমাস কবির
উদ্যোক্তা হতে চাইলে সাহস থাকতে হবে। ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। চাকরি ছাড়ার সাহস থাকতে হবে।
আমাকেও চাকরি ছাড়তে হয়েছিল।
সাহস নিয়ে এগিয়েছিলাম বলেই এ অবস্থানে আসতে পেরেছি। উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়ন। আইডিয়া থাকলেই প্রথমে কেউ অর্থায়ন করতে রাজি হয় না। দুশ্চিন্তার কিছু নেই, লেগে থাকতে হবে। অনেকেই ভালো আইডিয়া নিয়ে বসে থাকে; কিন্তু অর্থায়নের অভাবে তা বাস্তবায়ন করতে পারে না।
আইডিয়া ভালো হলে এবং ধৈর্য ধরে থাকলে সফলতা আসবেই। সব সময় ব্যতিক্রম কিছু ভাবতে হবে। উদ্ভাবনী হতে হবে, অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে হবে। দেশ প্রতিনিয়ত তথ্যপ্রযুক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সবকটি সেক্টরে এখন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তাই সবকিছুতে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষার্থীদের এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে। আর শিক্ষকদের এ বিষয়ে আরও যতœ করে শেখাতে হবে।

নাছিমা আক্তার নিশা

উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে। এসব কর্মশালায় নারীদের উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। আসলে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়ে। প্রথম বাধাটা আসে পরিবারের কাছ থেকে। কিন্তু বাধা অতিক্রম করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে। আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি কী হতে চাই। আমি কি চাকরিজীবী হব, নাকি গৃহিণী, নাকি উদ্যোক্তা হব। লক্ষ্যটা স্থির করতে হবে আগে। সাহসের সঙ্গে আগে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে যে, আমি নিজে কিছু করতে চাই। লক্ষ্য স্থির থাকলে কাজ অর্ধেক হয়ে যায়। এরপর পরিবারের সমর্থন নিতে হবে। কারণ পরিবারের সমর্থন পেলে মেয়েদের জন্য সুবিধা হয়। সমর্থন না পেলে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের সময় পরিবারের পক্ষ থেকে খুব কমই সাপোর্ট পাওয়া যেত। বলত, কাজের কী দরকার। তবে এখন পরিবারগুলো কিছুটা হলেও মেয়েদের সমর্থন দিচ্ছে। তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

সৌরভ ইসলাম

সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যে, চেষ্টা করলে অবশ্যই নিজে কিছু করতে পারবে। উদ্যোক্তা হতে চাইলে অনেক কিছুতে ছাড় দিতে হয়। অনেক সময় বড় সুযোগকেও বাদ
দিতে হয়।
আমার কথাই ধরুন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে রকেট ইন্টারনেটে কাজ করার সময় আমাকে সিঙ্গাপুরে বদলি করা হয়। ভালোই ছিল চাকরিটি। ভালো বেতন ছিল,
সুযোগ-সুবিধাও ছিল অনেক। কিন্তু আমি সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। নিজে কিছু করব বলে ঠিক করি। কারণ আমার মা খুব অসুস্থ ছিলেন। আমি চাইছিলাম তার সঙ্গে থাকতে; কিন্তু আমার কাছের মানুষরা, এমনকি আমার মাও এটাকে সমর্থন করেননি। অথচ মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হই। কারণ আমার বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাসই ছিল সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
আমি যখন ঢাকায় চলে আসি, তখন সবাই বলছিলÑতুমি বড় সুযোগ হারিয়েছ। আমি গুগল পার্টনারশিপ নিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। আমাকে চারজন মানুষকে বেতন দিতে হতো। ভাগ্য সহায় ছিল। আমরা কী পড়েছি, তা ভুলে যাই। তবে থিউরির সঙ্গে প্র্যাকটিকেলের সমন্বয় ঘটাতে হবে। বিজনেসের সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তির মিলন ঘটাতে হবে। বিজনেসের পাশাপাশি আইটি সম্পর্কেও যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে। আমি নিজে বিজনেসের ছাত্র হলেও আমাকে আইটি সম্পর্কিত কাজই বেশি করতে হয়।

আমান আশরাফ ফাইজ

উদ্যোক্তাকে বাজার ও গ্রাহকের চাহিদা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। গ্রাহকের কাছে যেতে হবে, তাদের চাহিদা সম্পর্কেও জানতে হবে। কোনো পণ্যের যে দাম নির্ধারণ করা হবে, তা তার কাক্সিক্ষত গ্রাহকের ক্রয়সীমায় থাকবে কি না, তা নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট রাখতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত থাকতে হবে। পণ্যের জন্য ব্র্যান্ডিং অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সাবানের কথা জিজ্ঞেস করলে আমাদের চোখের সামনে সবার আগে আসে লাক্সের নাম। এটাই হলো ব্র্যান্ডিং।
কোনো পণ্যের ব্র্যান্ডিং ভালো হলে তার বিক্রিও তুলনামূলক বেশি হবে। আবার ব্র্যান্ডিংটা নির্ভর করে পণ্যের মান ও প্রচারের ওপর। এসব বিষয়ে উদ্যোক্তাকে নজর রাখতে হবে।

ইমরান ফাহাদ
উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন একটি বড় বিষয়। অর্থায়ন না হলে কোনো আইডিয়াই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আইডিয়া ও উদ্ভাবককে দেখেই কেউ অর্থায়ন করতে চাইবেন। সেক্ষেত্রে আইডিয়া যেমন সুন্দর হতে হবে, তেমনি উদ্যোক্তাকেও হতে হবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।
অর্থায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নকিয়া ফোনের বিষয়টিই দেখুন। একসময় বাংলাদেশের বেশিরভাই মানুষ নকিয়া ফোন ব্যবহার করত। বাংলাদেশে নকিয়ার একটি বড় বাজার ছিল এবং মানুষেরও চাহিদা ছিল। কিন্তু বর্তমানে খুব কম মানুষই নকিয়া ফোন ব্যবহার করে। এর কারণ হলো সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন আইডিয়া এসেছে। অনেক কিছু আপডেট হয়েছে। অ্যানড্রয়েড এসেছে, স্মার্টফোন এসেছে; কিন্তু নকিয়া সে ধারায় মিশতে পারেনি, তারা আপডেট হতে পারেনি, গ্রাহকের চাহিদা বুঝতে পারেনি। এ কারণে তারা তাদের মার্কেট হারিয়েছে। গ্রাহকের চাহিদা ও সামর্থ্যরে বিষয়টি নিয়ে উদ্যোক্তাকে ভাবতে হবে। আপনার আইডিয়া যদি আপনার কাক্সিক্ষত গ্রাহক গ্রহণ না করেন, তাহলে সে আইডিয়া বাস্তবায়ন হবে না। কাজেই প্রযুক্তি সম্পর্কে সব সময় আপডেট থাকতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০