উন্নয়নশীল বিশ্বের সংকট, বাস্তবতা এবং করণীয়

এইচ এম নাজমুল আলম: দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা তাদের ইতিহাসের ভয়াবহতম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি দেশটি। শ্রীলংকার এই অর্থনৈতিক সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি; গত ১৫ বছর ধরে এ সমস্যা ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়েছে। ক্ষমতাসীন মাহিন্দা রাজাপক্ষে পরিবারের ব্যাপক দুর্নীতি, অনুৎপাদনশীল বৃহৎ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, অহেতুক করহার হ্রাস, উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উচ্চাকাক্সক্ষায় মুদ্রা ছাপানো, অর্গানিক কৃষির জন্য সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় উৎপাদন হ্রাস, রেমিট্যান্স ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল দেশটির ওপর করোনার অভিঘাতে আয় কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ঋণের মাধ্যমে আলঙ্কারিক ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে প্রায় শতভাগ শিক্ষিত জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা আজ গভীর সংকট আর অনিশ্চয়তায় দিকভ্রান্ত। প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলমান করোনার অভিঘাতে এমনিতেই সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশই এখন পর্যন্ত করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের সংকটের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি অনেক দেশের জন্যই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকট অব্যাহত থাকলে বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে যে অদূর ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের সম্ভাবনা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানীগুণী বোদ্ধারা ইতোমধ্যেই আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলছেনÑবাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে কি না। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রায় প্রতিটি দেশেরই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন এবং প্রতিটি দেশের ডেভেলপমেন্ট মডেলও একই রকম নয়। বাংলাদেশের এ যাবতকালের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিশ্চয়ই শ্রীলঙ্কার বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো নয়। সে যাই হোক, বাংলাদেশ কখনও শ্রীলঙ্কা হবে কি না সেই বিতর্কে নতুন করে না জড়িয়ে আমাদের বরং লক্ষ্য করা উচিত শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কী শিক্ষা নেয়ার রয়েছে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনপ্রিয়তা কখনও ধ্রুব নয়। কিন্তু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পর তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের ক্ষমতাসীনরাই এ বাস্তবতাকে ভুলে যান কিংবা অস্বীকার করতে চান। যদিও তৃতীয় বিশ্বের ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা কম নয়, তারপরও যতটুকু অবশিষ্ট থাকে সেটি নিয়েই চলতে হয় আমাদের। আজ আপনি জনপ্রিয়তার নিরিখে শীর্ষে অবস্থান করছেন তার মানে এই নয়, বছরের পর বছর আপনার সেই জনপ্রিয়তা অটুট থাকবে। দূরদর্শিতার সঙ্গে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হলে দুর্নীতি-অপশাসন এবং স্বজনপ্রীতিতে সরকার কাঠামো ডুবে গেলে আপনার জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবেই। দ্বিতীয়ত, মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন সে প্রতিবাদী হয়ে উঠবেই। উন্নয়নশীল বিশ্বের সাধারণ জনগণ সম্পর্কে ক্ষমতাসীন সরকার প্রায়ই মিস ক্যালকুলেশন করে ফেলে। জনগণ সর্বংসহা নয়, তারা চরম ধৈর্যশীল। তাদের এই ধৈর্যকেই ক্ষমতাসীনরা দুর্বলতা ভেবে বসেন। একবার যদি জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তবে তার চরম মূল্য দিতে হয় অপশাসকদের। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীলংকায়, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে পুলিশের বড় কর্মকর্তারা বিক্ষোভকারীদের রোষানলে পড়ছেন, পদে পদে পর্যদুস্ত হচ্ছেন। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন তাদের মনে রাখতে হবে, জনবিচ্ছিন্ন থেকে কখনও ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখা যায় না। তৃতীয়ত, কোনো একটি বা দুটি বিশেষ খাতের ওপর নির্ভর করে কোনো দেশের অর্থনীতি বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো একটি বিশেষ খাতে একটি দেশের অবস্থান ভালো তার মানে এই নয়, সেই খাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হবে না। কখনও সেই বাজার হারিয়ে বসলে বিকল্প  কোনো খাত যেন অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে পারে সেই ব্যবস্থাও আগে থেকে তৈরি করে রাখতে হয়। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, অপ্রত্যাশিত কভিডের অভিঘাতে শ্রীলঙ্কার পর্যটন এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ওপর দেশটির নির্ভরতা ছিল সর্বাধিক। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল দুটি স্তম্ভ পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্স। দুটি খাতেই বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়, তবে আমাদের বিকল্প খাতেও অধিক নজর দিতে হবে। পোশাকশিল্প এবং প্রবাসী আয়ের বর্তমান অবস্থানের পেছনে এ দেশের সস্তাশ্রম নিঃসন্দেহে অনেক বড় বাস্তবতা। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় যেভাবে আফ্রিকার দেশগুলোতে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে, তাতে সেসব দেশগুলোয় আরও সস্তায় যখন শ্রম পাওয়া যাবে, বাজারও সেদিকে ঘুরে যাবে। সুতরাং একটি দুটি খাতে ভালো অবস্থানের পরও বিকল্প টেকসই খাতে দূরদর্শিতার সঙ্গে বিনিয়োগসহ অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবতায় অতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ এবং আমদানি নির্ভরতা কখনোই দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। একটি দেশের কতটুকু অর্থনৈতিক সক্ষমতা রয়েছে, সেটি যাচাই না করে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি গভীর সংকটে পতিত হয়। আবার আমদানি নির্ভরতার ফলে বৈশ্বিক সংকটে চরম মূল্য দিতে হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। বিষয়টি শুধু শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেই নয়, বরং তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্যই ধ্রুব সত্য।

দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বদরবারে প্রশংসনীয় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের বটে। ভুলে গেলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পার করলেও আমাদের সমস্যা-সংকটের অন্ত নেই। কাগজে-কলমে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়লেও একই সঙ্গে বেড়েছে আয় বৈষম্য। বিশ্বে দ্রুত কোটিপতি তৈরি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে থাকলেও টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্তদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। কভিডের অভিঘাতে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটি সামলে ওঠায় বাংলাদেশ বেশ কৃতিত্ব দেখিয়েছে বটে, তবে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যেভাবে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য-জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তাতে আরও সংকট অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। দেশের নীতিনির্ধারক যারা রয়েছেন তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে এবং বাস্তবতার নিরিখে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের যে সুসম্পর্ক রয়েছে সে কথা বলা যায় না! কারণ সাধারণ মানুষ প্রতিদিন চলতে-ফিরতে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে থাকে, সেই বাস্তবতা থেকে নীতিনির্ধারক মহল বেশ দূরত্বেই অবস্থান করেন। তবে নীতিনির্ধারক মহলের কেউ যদি সাধারণের কাতারে নেমে এসে একটি দিন গণপরিবহনে করে অফিসে যেতেন কিংবা পাসপোর্ট অফিসের লাইনে দাঁড়াতেন অথবা সরকারি অফিসে ফাইল জমা দিতে কিংবা খবর নিতে যেতেন, তবে দেশের অবস্থা যে রাতারাতি পাল্টে যেত, তা হলফ করেই বলা যায়। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায়ই আশায় বুক বেঁধে রয়েছি।

প্রভাষক

আইইউবিএটি

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০