রেজাউল করিম খোকন : কভিডকালে সাবধানতা অবলম্বন করতে মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অধিক হারে আকৃষ্ট হয়েছে। ওই সময় বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকের সুবিধার জন্য চালু করেছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা। বিমাযুক্ত আমানত পণ্য চালু, সহজে অনলাইনে টাকা স্থানান্তর, ঘরে বসে সহজে দ্রুত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অনলাইনে কেনাকাটাসহ বিশেষ কিছু নতুন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক করোনাকালে গ্রাহকদের ব্যাংকে না এসে কীভাবে সেবা দেয়া যায় তা উদ্ভাবনের নানা প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো শিখেছে কীভাবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স প্রভৃতি সম্পন্ন করা যায়। করোনাকালে ব্যাংকগুলো তাদের বোর্ড মিটিংসহ বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন করেছে। ভার্চুয়ালি বোর্ড মিটিং, ট্রেনিং ,ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স প্রভৃতি সম্পন্ন করার কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যয় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বদলে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে মানুষের কর্মকাণ্ডের ধরনও পাল্টাতে হয়। পুরোনো কলাকৌশল নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে অচল কিংবা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল একসময় এ অঞ্চলে। কিন্তু সেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমেই বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবাখাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি। এখন আর আমাদের অর্থনীতিতে কৃষির একচ্ছত্র দাপট নেই আগের মতো। নানা চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বোপরি উন্নয়নের সব সেক্টরে টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অব্যর্থ কৌশল উদ্ভাবনে সবাই সচেষ্ট এখন। টেকসই উন্নয়নের জন্য দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সফলতা তার কর্মিবাহিনীর দক্ষতা, জ্ঞান ও উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভর করে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার, সৃজনশীলতার প্রয়োগ ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ জরুরি।
এখন সর্বত্র উন্নয়নের জন্য ইনোভেশন অর্থাৎ উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। সবাই ‘ইনোভেশন’ নিয়ে কথা বলছেন। ইনোভেশন বলতে কী বোঝায়? ‘ইনোভেশন’ বা উদ্ভাবন হচ্ছে প্রচলিত কর্ম বা সেবার প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করা, যা সবার জন্য নতুন সুবিধা বা উপকার তৈরি করে। নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন বলতে সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় এমন কোনো পরিবর্তনের সূচনা করা, যার ফলে সংশ্লিষ্ট সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের আগের তুলনায় সময় বাঁচে এবং ব্যয় সাশ্রয় ও কষ্ট লাঘব হয়। এমনিতেই ইনোভেশন ধারণাটি বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। সাধারণভাবে উদ্ভাবন বা ইনোভেশন বলতে আমরা বুঝব অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, সেক্টর বা দেশ থেকে কোনো সৃজনশীল চর্চা নিজ ক্ষেত্রে অনুকরণ করা, সম্পূর্ণ নতুন একটি চর্চার অবতারণা করা, প্রশাসনিক পদ্ধতি অথবা সেবা প্রদানের প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করা। এই ছোটখাটো পরিবর্তন ক্রমাগতভাবে বিদ্যমান অবস্থা ও পদ্ধতির ধারাবাহিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। সাধারণত উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্য সৃজনশীলতা প্রয়োজন। তবে এটা মনে রাখতে হবে, সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবন এক জিনিস নয়। দুটো আলাদা বিষয়। যেখানে সৃজনশীলতা প্রধানত মনোজাগতিক ও ধারণাভিত্তিক, সেখানে উদ্ভাবন প্রায়োগিক বা চর্চাকেন্দ্রিক।
বাংলাদেশে এখন টেকসই উন্নয়নের জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। সরকার সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। কম সময়ে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নির্ঝঞ্ঝাটে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োগে নতুন কৌশল উদ্ভাবনের প্রতি বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। যেমন নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন বলতে সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় এমন কিছু পরিবর্তনের সূচনা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা নাগরিকের আগের তুলনায় সময়, খরচ, অফিস বা কর্মস্থলে যাতায়াতের সময় সাশ্রয় হয়। প্রচলিত প্রশাসনিক উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে কলাকৌশলের পরিবর্তন করার মাধ্যমে হোক, কিংবা অন্য কোনো দেশের অনুকরণে কিংবা সম্পূর্ণ নতুন কৌশল অনুসরণ করে হোক, যদি সাধারণ মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়, কষ্ট লাঘব হয়, দুর্ভোগ অব্যবস্থার অবসান ঘটে তাহলে সেটাকেই আমরা ইনোভেশন হিসেবে গণ্য করতে পারি। আবার অতীতে যেসব কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়নি কিংবা চর্চা করা হয়নি, তা প্রয়োগের সুবাদে প্রশাসনে ব্যবস্থাপনার নতুন ধারা সৃষ্টি হয়, কর্মচাঞ্চল্য, উদ্দীপনা বেড়ে যায়, তাহলে সেটাও এক ধরনের ইনোভেশন বা উদ্ভাবন বলে গণ্য হতে পারে।
সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কর্ম উদ্যোগে যেহেতু নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই করা হয়, সেহেতু এর প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতার ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। ইনোভেশন বা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সাফল্যপ্রত্যাশী থাকেন সবাই। তবে সব প্রচেষ্টাই সাফল্যে পর্যবসিত হবে তেমনটি আশা করাও বোকামি। ইনোভেশনের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ব্যর্থতার ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। উদ্ভাবনী সক্ষমতা সব সময় ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের মধ্যে থাকবে তাও নয়। উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্যোগ ঐতিহ্যগতভাবে কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও আসতে পারে। সাধারণত নিম্ন পর্যায়ে থেকে আগত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের এবং স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও এটা আসতে পারে। সাধারণত নিম্ন পর্যায়ে থেকে আগত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের এবং স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যাকেন্দ্রিক, যা সরাসরি প্রান্তিক সেবা গ্রহীতাদের জন্য নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে। সরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নেতৃত্ব, জনপ্রশাসনে উদ্ভাবনী সংস্কৃতির বিকাশ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, গণকর্মচারীদের দক্ষতা, প্রণোদনা ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা জরুরি বলে ধরা হয়। জনপ্রশাসনে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
আর উদ্ভাবনের সফলতার জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বা দলনেতার অবশ্যই সরকারি খাতে উদ্ভাবন সম্পর্কে, উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে, সম্পৃক্ত উপকারভোগী গোষ্ঠীর সমস্যা ও চাহিদা এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে কোথায় কোন সময়ে উদ্ভাবন প্রয়োজন, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এখন দুনিয়াজুড়ে সরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবনের লক্ষ্য নানা প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ সহজেই চোখে পড়ে। এটা হঠাৎ বিশেষ কোনো প্রয়োজনে না হয়ে প্রাত্যহিক রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইনোভেশন বা উদ্ভাবন যাতে ঠুনকো কোনো বিষয় না হয়ে টেকসই হয়, সেজন্য সরকারি দপ্তরে দপ্তরে পৃথক ইনোভেশন টিম গড়ে তোলার বিষয়টি এখন খুব চোখে পড়ছে।
উদ্ভাবনের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে খুবই তৎপর হতে হবে আমাদের। সব মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তরে উদ্ভাবনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কারিগরি সহযোগিতা এবং প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় কর্মসূচিসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা গোটা দেশব্যাপী প্রশাসন, ব্যাংক ব্যবস্থা, প্রকল্প উন্নয়ন ও দাপ্তরিক কাজকর্মে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। সব জায়গাতেই এটাকে পজেটিভলি গ্রহণ করা হয়েছে। সবাইকে আজ এটা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে, যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং এর মাধ্যমে জনগণের কাক্সিক্ষত সেবাকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। উদ্ভাবনে সফলতার নির্ধারিত বিশেষ কোনো ফর্মুলা বা উপায় নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সফলতা পেতে হলে যোগ্য ও কার্যকর নেতৃত্ব, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহযোগিতা ও প্রণোদনা লাভের পাশাপাশি উদ্ভাবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আমরা আসলে কী চাইছি, আমাদের গন্তব্য কোথায়, কত দূর যেতে চাইÑএসব ঠিক করে তারপর এগোতে হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবন সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার সময় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা স্মরণ রাখতে হবে, এই উদ্যোগ সর্বসাধারণের মঙ্গল ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এর মাধ্যমে জনদুর্ভোগ দূর হয়ে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। অতএব উদ্ভাবনী উদ্যোগে সমাজের সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
ভবিষ্যতে সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগেই নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে তা প্রয়োগ করতে হবে। গতানুগতিক কর্মপদ্ধতি, যা যুগের দাবি মেটাতে পারছে না, যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে না, যা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা বিশ্বমানের পর্যায়ে দেশকে নিয়ে যেতে পদে পদে বিঘ্নসৃষ্টি করছে, সেই পুরোনো কর্মপদ্ধতি বাদ দিয়ে নতুন পদ্ধতি, কলাকৌশল উদ্ভাবনে সবাইকে তৎপর হতে হবে। অর্থনীতি, ব্যাংক ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা, নাগরিক সেবার মান উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণÑ প্রতিটি সেক্টরেই উদ্ভাবনের জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে।