উন্নয়নের প্রতিবন্ধক দুর্নীতি

মো. কামাল হোসেন: সমাজে একসময় সজ্জন ব্যক্তির একটি আলাদা পরিচিতি ছিল, তাকে সম্মান দেওয়া হতো। ব্যক্তি শিক্ষিত হলে তার কদর আরও বেড়ে যেত। সময়ের পরিক্রমায় সে জায়গাটি এখন পেশিশক্তির অধিকারী বা দুর্নীতিবাজ অঢেল সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দখলে। সমাজের এ পরিবর্তন প্রকারান্তে দুর্নীতিকে ও পেশিশক্তিকে প্রমোট করছে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি সমাজে নিজেকে দানবীর হিসেবে পরিচিত করতে, কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ নির্মাণসহ নানা ধরনের লোকদেখানো উন্নয়ন কাজ করছেন, যার পেছনে রয়েছে সুদূরপ্রসারী কুমতলব। দুর্নীতিবাজ আর পেশিশক্তির কাছে সজ্জন ব্যক্তিদের পরাজয় আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়কে আরও ত্বরান্বিত করছে। সংগত কারণে দুর্নীতি আর পেশিশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে সমাজ ভেঙে পড়বে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ, কুনীতি, অসদাচরণ, অসৎ উপায় অবলম্বন, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন, নীতিবিরুদ্ধ আচরণ প্রভৃতি। আর প্রতিরোধ অর্থ হচ্ছে নিরোধ, নিবারণ, বাধাদান, প্রতিবন্ধকতা, আটক, ব্যাঘাত প্রভৃতি। আভিধানিক অর্থে শব্দটি অত্যন্ত ছোট হলেও এর অর্থ ব্যাপক। দুর্নীতিকে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা যায় না। দুর্নীতি এমন এক ধরনের অপরাধ, যার সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার ও সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার যুক্ত। সাধারণ কথায় দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-উৎকোচ গ্রহণ বা মহল বিশেষের অশুভ স্বার্থ হাসিল করাকে দুর্নীতি বোঝায়।

একজন ব্যবসায়ী সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেন। ধর্ম পালন বা দান-সদকায় তিনি বরাবরই প্রথম সারিতে। কিন্তু তিনি মাঝেমধ্যে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে কারসাজি করেন। এটা দুর্নীতির উদাহরণ হলেও এটাকে তিনি দুর্নীতি মনে করেন কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। আবার কোনো সরকারি কর্মচারী ঘুষ নেন না, কিন্তু নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না, এটাকে যেমন দুর্নীতি বলব, তেমনি পরীক্ষাকেন্দ্রে অসদুপায় অবলম্বনকারী শিক্ষার্থীকে অনৈতিক সহায়তা করাও দুর্নীতি। দুর্নীতির বেশ কিছু চমকজাগানো সংবাদ করোনাকালে আমাদের চোখে পড়েছে। মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। টাকা আত্মসাতের জন্য করোনা পজিটিভ রিপোর্ট হয়ে গেছে নেগেটিভ, আবার উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। দুর্নীতি বড় হোক, ছোট হোক, উইপোকার মতোই তা দেশের উন্নতি ও প্রগতিকে ধ্বংস করে।

নিজের কাজটি সহজে পেতে অনেকেই উৎসাহী হয়ে ঘুষ বা উৎকোচ দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে ঘুষ বা উৎকোচ দিতে বাধ্য হন। দুর্নীতি নিয়ে নানাজনের নানা অভিমত রয়েছে। মোদ্দাকথায় দুর্নীতি তিন ধরনেরÑবড় দুর্নীতি, ছোট দুর্নীতি আর নীতিগত দুর্নীতি। বড় বড় রাষ্ট্রীয় কাজ কিংবা সমাজসেবার নামে হয় বড় দুর্নীতি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ছোটখাটো দুর্নীতিতে। আবার নিজেদের সুবিধার জন্য যদি কেউ সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নীতির অদলবদল করেন, তখন সেটা হয় নীতিগত দুর্নীতি। ছোট, বড় কিংবা নীতিগত যে ধরনের দুর্নীতি করেন না কেন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি সেটাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি মনে করেন না। কেউ এটাকে ভাবেন উপকার করা, কেউবা ভাবেন উপরি আয় হিসেবে।

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির বৈষম্য ও বঞ্চনার ইতিহাস গভীরভাবে অনুভব করতে পেরে আজীবন তাদের মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় তিনি সমাজের অসংগতি বুঝতে পেরে হুশিয়ারিও উচ্চারণ করেছিলেন‘বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ সব সমাজবিরোধী তৎপরতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যেসব সমাজবিরোধী ব্যক্তি শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রানি করছে এবং যারা দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকার ইতস্তত করবে না।’ সমাজের সব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নয়ন ও দুর্নীতি পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একটি দেশ যখন দরিদ্র অবস্থা থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়, তখন সে দেশে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দিতে পারে। দুর্নীতি অনেকটাই উন্নয়নের সহযাত্রী। অর্থাৎ একটি দেশ বা জনপদ যখন উন্নয়নের ধারায় ধাবিত হয়, তখন সেখানে নানা পর্যায়ে দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে এবং প্রশ্নাতীত রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, তাহলে দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব।

বিশ্বে কোনো দেশই দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারেনি। উন্নত দেশগুলোয় দুর্নীতি আছে, তবে তা সীমিত বা সহনীয় পর্যায়ে। তাই দুর্নীতি সেসব দেশের প্রধান সমস্যা নয়। তবে একটি সমাজে কোনোভাবেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির বিস্তার সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দ্রুত উন্নয়ন ও ব্যাপক দুর্নীতিও কাম্য হতে পারে না। অতি দরিদ্র কোনো দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হয়, তখন সেখানে অবধারিতভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। তিনি বলেছেন, ‘দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হলে, প্রশাসনকে হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত এবং নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন।’ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দলের কিছু দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করেছেন, কিন্তু কেউই রেহাই পাননি। সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দলের ভেতর থেকেই তিনি শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা এককথায় বিস্ময়কর। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে সাত শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল আট দশমিক ১৫ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায়, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করেছে। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী অনেক দেশকে অতিক্রম করে গেছে।

দুর্নীতিই উন্নয়নের প্রধান বাধা। এই দুর্নীতিই ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক সাম্য ও গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি। উন্নয়নের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে সুষমভাবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিকতা বা অন্য কোনো বিভাজনকে ন্যূনতম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যÑদুর্নীতিই আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে সামনে চলে আসছে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে মিশন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন। সমাজের সর্বস্তরে প্রবহমান একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতির চর্চা এবং এর প্রসার সুনিশ্চিত করা এবং উত্তম চর্চার বিকাশ সাধন করা এ কমিশনের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশ কিছু আইন ও বিধিমালা রয়েছে, যেমনÑদুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭ সংশোধনী, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯, সাক্ষ্য আইন-১৮৭২, ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৮, দণ্ডবিধি-১৮৬০, ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি)-১৮৯৮, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এবং তথ্য অবমুক্তকরণ নীতিমালা-২০১১ প্রভৃতি।

কমিশন দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ জাগ্রত করা তথা উত্তম চর্চার বিকাশে পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১৭-২০২১) কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। দুর্নীতির ঘটনা তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের লক্ষ্যে কমিশন ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই দুদক অভিযোগ কেন্দ্রের ‘হটলাইন-১০৬’-এর কার্যক্রম শুরু করে, যা এখন দেশের সাধারণ মানুষের অভিযোগ জানানো ও প্রতিকারের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ সবার কাম্য। শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। দুর্নীতি করলে আইনের আওতায় এনে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সেইসঙ্গে প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা, দেশপ্রেম ও তারুণ্যের অঙ্গীকার জাগ্রত করা। প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমরা দুর্নীতি করব না, অন্যকে দুর্নীতি করতে দেব না। অনিয়ম দুর্নীতি যে-ই করুক, প্রশ্ন তুলতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের চর্চাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শের চর্চার মাধ্যমেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০