উন্নয়ন প্রকল্পে জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজারের কুহেলিয়া নদী

কাইমুল ইসলাম ছোটন, কক্সবাজার: কক্সবাজারের উত্তর-পশ্চিমে চকরিয়া উপজেলা পেরিয়ে পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। জেলা শহর থেকে সাড়ে ৩৩  কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মহেশখালীর কুহেলিয়া নদী। উজানটিয়া থেকে শুরু হয়ে নদীটি ধলঘাটা, মাতারবাড়ী ও কালারমারছড়া ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এক সময় জোয়ার-ভাটায় আপন গতিতে ভরা যৌবনে প্রবাহিত হতো কোহেলিয়ার স্রোত। যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় এ নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা চলত। উৎপাদিত লবণ এখন থেকে নৌকা করে ঢাকা, খুলনা, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যেত। চট্টগ্রাম থেকে মালামাল আনা-নেয়াসহ মানুষ বড় নৌকা করে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করত। নির্দিষ্ট সময় পর পর নৌকা যেত এ নদী দিয়ে। নদীমাতৃক দেশে প্রাণচঞ্চল কুহেলিয়ার নদীর সেই চেনা দৃশ্য এখন রূপকথা।

এক সময়ের খরস্রোতা কুহেলিয়া জৌলুস হারাচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পে। দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদীটি। নদী দখল করে চার লাইনের সড়ক নির্মাণ করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলছে চিংড়ি ঘেরের নামে প্রভাবশালীদের নদী দখলের মহোৎসব। বছর দশেক আগে কয়েক হাজার মণের লবণের বোট চলাচল করলেও এখন সাধারণ নৌযান চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে। গত ১৪ মার্চ কুহেলিয়া নদী রক্ষার দাবিতে মানববন্ধনও করেছেন ৩টি পরিবেশবাদী সংগঠন।

স্থানীয়রা বলেন, এক সময় নদীটি অনেক গভীর ছিল। অনেক বড় বড় নৌকা ভিড়ত। এখন নদী দখল করে সড়ক নির্মাণ ও দূষণের ফলে নদীটি ছোট হয়ে গেছে। আগের মতো জোয়ার-ভাটা নেই। অনেক প্রভাবশালী চিংড়ি ঘেরের নামে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে প্যারাবন কেটে নদী দখল করছেন। নদী ভরাট হয়ে গেলে ধলঘাটা-মাতারবাড়ী মানুষের জনজীবন হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় পানি বন্দি হয়ে পড়েন কয়েক হাজার মানুষ।

স্থানীয়রা আরও বলেন, কুহেলিয়া নদীর গভীরতা না থাকায় পানির লবণাক্ততাও কমে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লবণচাষিরা। নদী ভরাট হয়ে গেলে মহেশখালীতে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাবে বেকারত্বের হার।

স্থানীয়রা পরিবেশ কর্মীরা জানান, কুহেলিয়া নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে মহেশখালীতে বসবাসরত দরিদ্র ২ হাজারের অধিক জেলে পরিবার। রাস্তা নির্মাণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ওই জেলে পরিবারগুলো পড়েছে বিপদে। মহেশখালী ও মাতারবাড়ী এলাকা দেশের লবণশিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নদী দিয়ে বছরে চার-পাঁচ মাস গড়ে দৈনিক ২০-২৫টি লবণের নৌকা যাতায়াত করত। অত্র এলাকায় ভারী শিল্পায়ন ও নদী ভরাটের কারণে লবণচাষি, সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছে। বারবার প্রতিবাদ করলেও দখল-দূষণ থামছে না বলে স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা জানান।

সরেজমিনে দেখা যায়, ব্রিজ থেকে দক্ষিণে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে যাওয়ার জন্য নদীর অর্ধেক অংশ দখল করে চার লেনের সড়ক নির্মাণের কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। সড়কটি যত দক্ষিণে তত নদী দখলের পরিমাণ বেড়েছে। তাছাড়া কালারমার ছড়ার ইউনুসখালী এলাকায় নদীর প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ভরাটের ফলে নৌ-যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে এভাবে জৌলুস হারিচ্ছে কুহেলিয়া নদী। অন্যদিকে মাতারবাড়ীর খন্দারা বিলে চিংড়ি ঘেরের নামে নদী দখল করছেন কয়েকটি চক্র।

স্থানীয় জেলে আবুল কালাম বলেন, আগে অনেক মাছ পাওয়া গেলেও, বর্তমানে মাছ পাওয়া যায় না। তাই মাসের প্রায় সময় কাজ না পেয়ে বেকার থাকি। সংসারে নেমে পড়ছে অশান্তি।

নয়ন দাশ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আগে বছরের এ সময় নদীতে আমরা অনেক কাঁকড়া পেতাম। যেগুলো বিক্রি করে সংসার চলত। বর্তমানে কাঁকড়া মিলে না, তাই নিজের জš§ভ‚মি ছেড়ে চট্টগ্রামের একটি কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। তার মতো আরও অনেকে কাঁকড়া ধরে জীবনধারণ করত বলে তিনি জানান।

কুহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, কুহেলিয়া নদীর সঙ্গে মহেশখালী মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত রয়েছে। কুহেলিয়া নদী ধ্বংস করা হলে মহেশখালী মানুষের ওপর চরম অন্যায় অবিচার করা হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ওজুহাত দেখিয়ে নদী দখল করে সড়ক নির্মাণসহ মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বর্জ্য ফেলা এবং চিংড়ি ঘেরের নামে নদী দখলের ফলে নদীটি হারিয়ে যাবে। কুহেলিয়া নদী দখলমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নদীটি উদ্ধারের দাবি জানান।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, দখল ও দূষণের ফলে কুহেলিয়া নদীটি এখন মৃত খাল। কুহেলিয়া নদী রক্ষা করা গেলে এটি চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে। তাতে রাষ্ট্র উপকৃত হবেন। তাই নদীটি রক্ষা করতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে কুহেলিয়া নদী বাঁচানো যাবে না। আমরা কুহেলিয়া নদী রক্ষায় অনেক আন্দোলন করেছি। প্রতিবাদ করেছি। তিনি কুহেলিয়া নদী রক্ষার দাবি জানান।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০