উন্নয়ন সহযোগিতায় চীনের ভূমিকা কি কমে আসছে!

ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল আলোচিত চীন সফরের মাধ্যমে প্রাপ্তি কতটা হয়েছেÑসেটি নিয়ে এখন চলছে নানা বিশ্লেষণ। চীন সফরে যাওয়ার কিছুদিন আগ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছিলেন, এ সফর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহযোগিতা তথা ঋণ পাওয়ার কথাও জানিয়েছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। যদিও চীন মাত্র এক বিলিয়ন ইউয়ান সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে রয়েছে হতাশা।

সূত্রমতে, চীন গত কয়েক বছরে বাংলাদেশকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা বা ঋণ সহায়তা দেয়নি। গত ১২ বছর মাত্র সোয়া সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছে দেশটি। তবে ছাড় হয়েছে অর্ধেকেরও কিছু বেশি। আর গত এক যুগের বেশি সময়ে চীন বাংলাদেশকে মাত্র ১১৪ কোটি ৬০ লাখ ইউয়ান বা প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার থেকে পাওয়া গেছে মাত্র সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মতো।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের আগে ধারণা করা হচ্ছিল, বাংলাদেশের দিক থেকে কয়েকটি বিষয় চীনের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। শুধু আলোচনাই নয়, বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকা যেসব প্রত্যাশা করে সেগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে চীন হয়তো ভূমিকা রাখবে। এর মধ্যে রয়েছে তিস্তা প্রকল্প, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য চীনের ঋণ।

যদিও সফর শেষে দুই দেশের দিক থেকে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে কোনো কথা নেই। এছাড়া বাণিজ্য, বিনিয়োগ কিংবা অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের দিক থেকে বড় কোনো প্রতিশ্রুতিও দেখা যাচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন অনেকে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে গত মে পর্যন্ত সাড়ে ১২ বছরে চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে সাত দশমিক ২৫৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বড় অংশই মিলেছে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে। সর্বশেষ ঋণচুক্তি হয়েছিল ২০২৩ সালের মার্চে রাজশাহী ওয়াসার পানি শোধানাগার নির্মাণ প্রকল্পে। গত মে পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ বছরে চীনের ঋণ ছাড় হয়েছে তিন দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গত অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে ছাড় হয়েছে মাত্র ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর চীনের ঋণ ছাড় হয়েছিল ২২১ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে গত এক দশকে তিনটি শীর্ষ সফর হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেন। অন্যদিকে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফর করেন। সে বছর অক্টোবরে শি জিনপিংয়ের মাত্র ২২ ঘণ্টার সফরে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে দুই দেশ। এর আওতায় ৩৪ প্রকল্পে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন, যার বড় অংশই অবকাঠামো ব্যবহার করার কথা ছিল।

যদিও গত পৌনে আট বছরে ওই প্রতিশ্রুতির এক-চতুর্থাংশও পায়নি বাংলাদেশ। এ সময়ে ঋণ চুক্তি সই হয়েছে পাঁচ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ঢাকা-সিলেট চার লেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেললাইন, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন রেলপথ, আখাউড়া-সিলেট ডাবল লাইন রেলপথ, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণের মতো বড় বেশকিছু প্রকল্পে চীনের ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে গেলেও নানা কারণে বাতিল হয়ে যায়।

সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর সফরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে চীনের কাছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছিল বাংলাদেশ। এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে সফরের আগে জানিয়ে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান।

গভর্নর সে সময় জানিয়ে ছিলেন, ঋণের অর্থ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে গ্রহণ করা হবে। এই অর্থ চীন থেকে পণ্য আমদানির ব্যয় মেটাতে ব্যবহার করতে পারবে বাংলাদেশ। তবে ঋণের আলোচনা এখনও কারিগরি পর্যায়ে রয়েছে; চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরে ঋণের বিষয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যদিও চীন মাত্র ১০০ কোটি ইউয়ান আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে, যা মাত্র পৌনে ১৪ কোটি ডলারের সমান। প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি অনেক কম হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা অনেকটাই হতাশ। যদিও বাংলাদেশকে সহায়তার ক্ষেত্রে বরাবরই পেছনের সারিতেই রয়েছে চীন। দেশটি গত এক যুগের বেশি সময়ে বাংলাদেশকে অনুদান দিয়েছে মাত্র ১১৪ কোটি ৬০ লাখ ইউয়ান। এর মধ্যে ২০২০ সালে সর্বশেষ ৫০ কোটি ইউয়ান অনুদান দিয়েছিল দেশটি।

গত ৪ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রিজার্ভের স্বল্পতা কাটাতে চীনের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময়ই এ-সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে এমন ইঙ্গিতও দেন মি. ওয়েন। তার এক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারকে উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানায়, চীনের কাছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ চায় বাংলাদেশ। কিন্তু শেখ হাসিনার চীন সফরে সেটির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

চীন সফরে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি নগণ্য বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। গতকাল তিনি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মোটা দাগে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কিছুই অর্জন করতে পারেনি। চীন গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে একটা বড় অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে। সেই নিরিখে সফরের আগে বাংলাদেশ সরকারের যে প্রত্যাশা ছিল তাতে আশাভঙ্গ হয়েছে বলাই যায়। আমরা বলে আসছি, বাংলাদেশের জন্য চীন হচ্ছে উন্নয়নের বন্ধু। সেই অবস্থান থেকে আমরা অনেকখানি সরে এসেছি আসলে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীরও মনে করেন, প্রত্যাশার আলোকে প্রাপ্তিটা খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অনেক বিষয়ে হয়তো আমরা সহমত হতে পারিনি। সেজন্যই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব একটা প্রাপ্তির যোগ দেখছি না। হয়তো দুই দেশের সাম্প্রতিক বোঝাপড়ায় কোথাও না কোথাও একটা ছন্দপতন হয়েছে। তারা যে আমাদের ওপর খুশি নয় সেটারই একটা বহিঃপ্রকাশ।’

আগে চীন বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং অর্থায়ন করেছে কিন্তু গত এক বছরে তেমন কোনো সহায়তা আসেনি বলেও উল্লেখ করে হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘চীনা প্রতিনিধি দল এসেছিল, চীনের রাষ্ট্রদূত আর্থিক সহায়তার কথা বলেছেন। চীনারা তো এমন কথা বলবেন না যেটার সারবত্তা নেই। নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা-সংক্রান্ত আলোচনা এগিয়েছিল।’ কোনো একটা কারণে তা ফলপ্রসূ হয়নি বলেই মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, চীন বরাবরই কঠিন শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। গত ১২ বছরে সই করা ঋণচুক্তির শর্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, চীনের ঋণের সুদহার দুই থেকে তিন শতাংশ। সঙ্গে শূন্য দশমিক ২০ থেকে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জও রয়েছে। ১৫ বছর মেয়াদি ঋণে সাধারণ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে থাকে চীন। আর দেশটির ঋণের প্রায় পুরোটাই বায়ার্স ক্রেডিট।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০