উন্নয়নে অংশীদার জিপিএইচ গ্রুপ

সাইফ ইউ আলম, চট্টগ্রাম:জিপিএইচ গ্রুপের ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে আশির দশকে। সেই সময়ে জাহাঙ্গীর অ্যান্ড আদার্স নামে ট্রেডিং ব্যবসা করতো তারা। তখন প্রতিষ্ঠানটি দেশের নানাপ্রান্তে ঢেউটিন, রড, সিমেন্টের মতো নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট পণ্য সরবরাহ করতো।

এরপর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে মোল্লা সল্ট গ্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে এমআই সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করে তারা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এ প্রতিষ্ঠানকে। একে একে নানা ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করে তারা। প্রতিষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয় জিপিএইচ গ্রুপ। তাদের উদ্যোগে ইস্পাত ও সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করা হয়।

জিপিএইচ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি পড়ালেখা করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। বছর পাঁচেক চাকরি করার পর ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ২০০০ সালে চট্টগ্রামে একটি ম্যানুয়াল রি-রোলিং মিল কিনেন। সেখানে নির্মাণ খাতের জন্য রড উৎপাদন শুরু করেন। ২০০৬ সালে এ প্রতিষ্ঠানের নাম দেন জিপিএইচ ইস্পাত। পণ্যের গুণগত মান ও ব্যবসায়িক জবাবদিহিতার কারণে ধীরে ধীরে তার প্রতিষ্ঠানটি সম্মানজনক অবস্থানে চলে আসে।

বর্তমানে ট্রেডিং ব্যবসার পাশাপাশি সিমেন্ট ও ইস্পাত উৎপাদন করছে এ গ্রুপ। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের এ দুটি প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। কর্মকর্তাদের বিচক্ষণতা ও কর্মীদের দক্ষতা প্রতিষ্ঠানটিকে অনন্য করে তুলেছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একে একে গড়ে উঠেছে ক্রাউন পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, ক্রাউন পলিমার ব্যাগিং লিমিটেড, ক্রাউন ম্যারিনারস লিমিটেড, ক্রাউন ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড, জিপিএইচ পাওয়ার লিমিটেড, ইনডে রি-রোলিং মিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও চিটাগং ক্যাপিটাল লিমিটেড। পাশাপাশি প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, প্রিমিয়ার পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ও চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডও এ গ্রুপের অংশীদার। এ ছাড়া তাদের নিজস্ব শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ রয়েছে। যেমন শিপিং, প্যাকেজিং ব্যাগ ও পাওয়ারের মতো কিছু সাপোর্টিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে জিপিএইচ গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠান একদিকে মূল কোম্পানির ব্যয় সাশ্রয় করছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান ও মুনাফা বৃদ্ধি করছে।

সম্প্রতি বড় ধরনের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে কাজ শুরু করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা যায়, নতুন বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করবে এ প্রতিষ্ঠান। ফলে কোম্পানিটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা দশগুণ বাড়বে। এ সম্প্রসারণ কার্যক্রমে ব্যবহার করা হবে সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তি। যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসাশ্রয়ী। একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধবও। এশিয়ায় প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে জিপিএইচ ইস্পাত এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যাচ্ছে। মেক্সিকোয় এ ধরনের একটি কারখানা রয়েছে। ইটালিতে তৈরি হতে যাচ্ছে এ প্রযুক্তির দ্বিতীয় কারখানা। আমাদের দেশে তৃতীয়টি তৈরি করবে জিপিএইচ ইস্পাত। সব ঠিক থাকলে কারখানাটি ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে উৎপাদনে যাবে।

বর্তমানে তারা বছরে এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন এমএস রড উৎপাদন করছে। তাদের এমএস বিলেট উৎপাদনক্ষমতা এক লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। সম্প্রসারণ কার্যক্রম শেষ হলে কোম্পানিটির এমএস বিলেটের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ১০ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টনে। আর এমএস রডের উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টনে। নতুন এ প্রযুক্তিতে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে অস্ট্রিয়ার প্রাইমেটালস টেকনোলজিস। প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল জানান, বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি-নির্ভরতা কমাতে চান তারা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে। কংক্রিট ভবনের পরিবর্তে ইস্পাতের ভবন তৈরির প্রবণতাও বাড়ছে। তবে জমি বাড়ছে না। এ কারণে ভবিষ্যতে উঁচু ভবন বা স্থাপনাই বেশি হবে। স্থানীয় বাজারে মানসম্মত ইস্পাত ও সিমেন্টের চাহিদা অনেক বাড়বে। ভবিষ্যতের চাহিদা মাথায় রেখেই তারা সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশে স্টিলের মাথাপিছু ব্যবহার ৩০ থেকে ৩২ কেজি। যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এ কারণে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন প্রযুক্তির জন্য দেশি-বিদেশি ব্যাংক থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেবে জিপিএইচ ইস্পাত। যার সুদের হার ৫-৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে। বাকি অর্থ প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব তহবিল ও শেয়ারবাজার থেকে রাইট শেয়ারের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। একই সঙ্গে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছ থেকেও সংগ্রহ করা হবে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জিপিএইচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নতুন প্রকল্পে উৎপাদন শুরু হলে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার রাজস্ব পাবে সরকার। এর মধ্যে করপোরেট কর বাবদ ৪০ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর বাবদ ৬০ কোটি টাকা, শুল্ক বাবদ ১৪০ কোটি টাকা ও বাকি ১০ কোটি টাকা নানা বন্দরের চার্জ হিসেবে দেওয়া হবে।

দেশে সিমেন্ট শিল্পে গৌরবের অংশীদারও এ গ্রুপ। বাংলাদেশ থেকে প্রথম সিমেন্ট রফতানি করে তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ক্রাউন সিমেন্ট।

নানা সামাজিক দায়িত্বও পালন করছে জিপিএইচ গ্রুপ। চট্টগ্রাম নগরকে ক্লিন ও গ্রিন সিটি করার জন্য কাজ করে চলেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এ কাজে তাদেরকে সহায়তা করার জন্য কয়েকটি ভ্যানগাড়ি প্রদান করেছে জিপিএইচ গ্রুপ। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কের সৌন্দর্য বর্ধনের দায়িত্ব নিয়েছে এ গ্রুপ। এ ছাড়া জেলা পুলিশের দায়িত্ব পালন আরও সহজ ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে একটি অত্যাধুনিক ডবল ডেকার পিকআপ উপহার দিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড। গ্রুপটি প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প সচেতনতা সৃষ্টি ও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০