উষ্ণতার আকুতি

সাধন সরকার:েশীত তার চিরচেনা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এখন শীতের ভরা যৌবন। শীতকাল দরিদ্র-গরিব মানুষের জন্য যেন এক অভিশাপের নাম! শীতের সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকার গরিব মানুষের সবচেয়ে বেশি কষ্ট পোহাতে হয়। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে প্রায় ৩ কোটিরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে আবার অতি দারিদ্র্যের নিচে বাস করে প্রায় দেড় কোটির মতো মানুষ। মূলত গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। এত বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের বিরাট একটা অংশের বিভিন্ন কারণে শীতকালে আবার কাজের সুযোগ কমে যায়। চরম মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে এসব কর্মহীন শীতার্ত মানুষ। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে থাকে। মূলত বস্তিতে ও ভাসমানভাবে বিভিন্ন এলাকায় শীতার্ত এসব মানুষের বাস। বাস্তবতা হলো, শীতের কবলে পড়ে ছিন্নমূল গরিব মানুষের অনেকে এ সময় মারা যায়।

এ বছর ধীরে ধীরে শীত জেঁকে বসতে শুরু করেছে। হাড়কাঁপানো শীতে জনজীবন জবুথবু হয়ে পড়েছে। শীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গরিব তথা খেটে খাওয়া মানুষ ‘যম’ বনে যাওয়া শীত মোকাবিলা করে অনেক সময় ঘরের বাইরে যেতে সাহস পায় না। উত্তরবঙ্গে তো বটেই, খোদ রাজধানী ও দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে গৃহহীন মানুষ শীতের রাতে কোনো রকমে পরস্পরের উত্তাপ নিয়ে জড়াজড়ি করে নিশি যাপন করে থাকে। শহরের ফুটপাতে, উড়ালসড়কের নিচে, অলিতেগলিতে, পার্ক-উদ্যানে অনেক মানুষ কোনো রকমে রাত যাপন করে। শীত সচ্ছল মানুষের কাছে পছন্দের ঋতু হলেও গরিব মানুষের কাছে যমদূতের সমান। কষ্ট ও ভোগান্তি ছাড়া শীত ঋতু গরিব মানুষকে আর কিছুই দিতে পারে না! তাপমাত্রার পারদ যতই নিচের দিকে নামতে থাকে ততই শ্রমজীবী মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়তে থাকে। আবার তীব্র শীতে ঘন কুয়াশার কারণে নদীপথ, আকাশপথ ও সড়কপথে ঠিকমতো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের একটা বিরাট অংশ শিশু ও বৃদ্ধ। তাদের কাছে শীতকাল মানে এক আতঙ্কের নাম। এমনিতেই শীতের সময় অতি দরিদ্র এসব পরিবারে ঠাণ্ডাজনিত রোগবালাই নতুন এক সমস্যা। শীতের কারণে ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিসহ হƒদরোগের প্রকোপ বাড়ছে। তীব্র শীতের আগ মুহূর্তে কমবেশি প্রতিদিনই হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আবার দেখা যাচ্ছে, শীতের প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে আগুন পোহাতে গিয়ে অনেকে অসাবধানতাবশত দগ্ধ হচ্ছে!

সত্যি কথা বলতে, ঋতুচক্রের গতি-প্রকৃতি আর আগের মতো নেই। আবহাওয়া দিনে দিনে চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। কখনো প্রচণ্ড গরম, আবার কখনও প্রচণ্ড শীত। এই পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না ছিন্নমূল-গরিব মানুষ। শীতে প্রকৃতি আরও রুক্ষ্ম রূপ ধারণ করে। প্রকৃতির উদাস সুর শীতার্তদের আরও কাবু করে ফেলে। অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, শীতকালে অতিথি পাখির আগমন প্রকৃতি-পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ভ্রমণের জন্যও উপযুক্ত সময় এই শীত ঋতু। যদিও ছিন্নমূল-গরিব মানুষের কাছে এসব মূল্যহীন! গরিব মানুষের পক্ষে খাদ্য ও স্বাভাবিক বস্ত্রের জোগান করা এমনিতেই কষ্টকর। তার ওপর আবার শীত বস্ত্রের উষ্ণতা পাওয়া সে তো বিলাসিতা! কিন্তু অন্য সব মানুষের মতো গরিব মানুষও শীতের সময় সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার অধিকার আছে। এ ব্যাপারে সামর্থ্যবান যেকোনো মানুষ ও বিভিন্ন সংস্থার উচিত শীতার্ত মানুষের পাশে এগিয়ে আসা। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিত্তশালীদের শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। নতুন কিংবা পুরোনো পরিষ্কার শীতবস্ত্র, অল্প দামে বাজারে পাওয়া দেশি-বিদেশি শীতবস্ত্র দিয়ে শীতার্তদের সহায়তা করা যেতে পারে। কিংবা টাকা-পয়সা দিয়েও শীতার্তদের সহায়তা করা যেতে পারে। প্রতি বছর দেখা যায়, শীতার্তদের সহায়তায় সরকার, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সম্মিলিত প্রচেষ্টা কখনও বৃথা যায় না। তাই শীত মৌসুমে শীতার্তদের কথা কখনও ভুলে গেলে চলবে না। শীতের প্রকোপ থেকে রেহাই দিতে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি হাসপাতালের মাধ্যমে শীতজনিত রোগের ওষুধ বিতরণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক বিত্তবান ও সামর্থ্যবান মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যার যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই শীতার্ত মানুষগুলোর প্রতি। এতে শীতার্তরা একটু হলেও উষ্ণতা পাবে, ভালো থাকবে।

শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী

sadonsarker2005@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০