আশরাফুল ইসলাম : বাংলাদেশ সবুজ-শ্যামল দেশ হিসেবেই সবার কাছে সমাদৃত। এই দেশের আবহাওয়ায় শরৎকালে যেমন শীত থাকে গ্রীষ্মকালে তেমনই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে খানিকটা গরম আনে। এ যে ঋতুবৈচিত্র্য, এটাই এই দেশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় আরও কয়েকগুণ। গ্রামাঞ্চলে এ সময়টায় চলে ধান কাটার মৌসুম। নতুন ফসলের ম-ম গন্ধে কৃষক-কৃষানিদের আনন্দের স্রোত বয়ে যায় পুরো দেশে। সবুজ-শ্যামল এ বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ হলেও প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার একমাত্র কারণ হলো বাংলাদেশের বনাঞ্চল ও বৃক্ষ নিধন কর্মসূচি।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ পরিবেশের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে যেমন নির্মল রাখে তেমনি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে প্রাণীর বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নির্গমন করে। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে দিনে দিনে প্রতিনিয়ত গাছ নিধন হচ্ছে। এর কারণে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে; আবহাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ দেশের বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে যাওয়া। নির্বিচারে বন উজাড় ও জনসংখ্যার চাপে দিনে দিনে তা আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি বছরই কারণে-অকারণে প্রচুর গাছ কাটা হয়, রোপণ করা হয়, তাও আবার পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে বনাঞ্চল বা বনভূমি দিনে দিনে উজাড় হচ্ছে। ফলে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে। কালবৈশাখী, সাইক্লোন, অকাল বন্যা প্রভৃতি দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যেকোনো দেশের ২৫ শতাংশ ভূমিতে বনজঙ্গল থাকা দরকার। সেই তুলনায় বাংলাদেশে গাছ নিধনের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে বনভূমি নেই। গত বছরে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ তথ্য মানতে নারাজ। মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি আছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষরাজি শব্দদূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে বনের জমি ব্যবহƒত হচ্ছে। তাই সরকার বর্তমানে বনভূমি রক্ষা করার পাশাপাশি বনের বাইরে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছে।
অনেক প্রাণী গাছ খেয়ে বেঁচে থাকে আবার গাছই তাদের একমাত্র আবাসস্থল। বন উজাড়ের কারণে এসব প্রাণী যেমন তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারছে না, তেমনি আবাসহীন হয়ে পড়ছে। ফলে এসব প্রাণী দিনকে দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড়ের দরুন নানা জাতের গাছগাছালি, নানা জাতের প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষার্থে গাছ নিধন বন্ধ করতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ এবং কঠোর আইন প্রণয়ন ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইদানীং একটি বিশেষ মহল কর্তৃক সারাদেশেই ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন চলছে। বন বিভাগের ফাইলপত্র ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, দেশের যেসব এলাকায় কিছু বনাঞ্চল ছিল তা নির্বিচারে কেটে শুধু উজাড়ই করা হচ্ছে না, নিশ্চিহ্নও করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের মূল্যবান বৃক্ষাদি কেটে বনভূমি উজাড়ের খবর দেশের সব মহলের জানা। এ কাজে বন বিভাগের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তার সঙ্গে রয়েছে অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী।
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় বনাঞ্চলের বিকল্প নেই। একথা ইতোমধ্যে বিশ্বের সব মানুষ অনুধাবন করতে শুরু করেছে। তাই লাখ লাখ ডলার খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যের বালুর পাহাড়ে বৃক্ষচারা রোপণ, পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করা হচ্ছে। মরুময় এসব দেশে গাছপালার বদৌলতে বৃষ্টিপাত হতে শুরু হয়েছে। সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে ওঠার আগে আমাদের সচেতনতার সঙ্গে যেখানে সম্ভব বৃক্ষরোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় আমাদের মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। ইদানীং ইটের ভাটায় অবাধে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। আইন ও নিয়মনীতি না মেনে গড়ে ওঠা পরিবেশ বিধ্বংসী এসব ইটের ভাটা এখন জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। শ্রমশক্তি সহজলভ্য, জমিও অতি সস্তা। অভাবতাড়িত কৃষক, দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমিক পেটের দায়েই চোখ বুজে শ্রম দিচ্ছে ইটভাটায়। অনেক কম ব্যয় অথচ অনেক বেশি মুনাফা এতে। অপরিণামদর্শী কিছু উদ্যোক্তার পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপে ইটভাটার নামে এভাবেই কৃষির সর্বনাশ এবং জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির কবলে পড়ছে। কিন্তু এসব নিষ্ঠুর বাস্তবতা বিবেচনায় না এনেই দিন দিন এ ধ্বংসাত্মক বিনিয়োগের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে উদ্যোক্তাদের। এ উদ্যোগ স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে প্রবাসী এমনকি অনেক সম্মানজনক পেশার মানুষ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ও পরিবেশগত প্রভাবকে অবহেলায় রেখে ইটভাটা ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গ্রামে-গঞ্জে ও বনে-বাদাড়ে ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার বেশির ভাগেই নেই বিএসটিআই লাইসেন্স বা পরিবেশ ছাড়পত্র। এসব ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের গুণগত মান নিশ্চিত করারও কেউ নেই। বন উজাড়করণ বলতে ব্যাপক হারে বৃক্ষ কর্তনকে বোঝায়। বর্তমানে এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন উজাড়করণের অনেক কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বন উজাড় করার প্রধান কারণ। মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কাঠ ব্যবহার করে। বৃক্ষ কেটে বনভূমিতে তারা তাদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। ফলে, দ্রুত গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। মানুষ এবং প্রাণীর ওপর বন উজাড়করণের অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। বন উজাড়করণ বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করে। একটি পরিবেশগত ভারসাম্য বাধাগ্রস্ত করে। এটি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে আনে। বন উজাড়করণ প্রাণিকূলেরও ভীষণ ক্ষতি করে। বন উজাড় করার কারণে বেশির ভাগ প্রাণী তাদের বসবাসের স্থান হারিয়েছে। জলবায়ুর ওপর এটির অনেক ক্ষতির প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে আমাদের জলবায়ুর আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সমুদ্র উচ্চতা ভীতিকর মাত্রায় বাড়ছে। বন উজাড় বন্ধে কর কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বৃক্ষ নিধনের ক্ষতিগ্রস্ত পরিণতিগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে।
শিক্ষার্থী
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট