সৈয়দ মহিউদ্দীন হাশেমী, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার হোয়াইট গোল্ড খ্যাত অন্যতম রপ্তানি পণ্য হিমায়িত চিংড়ি শিল্প এখন মহাসংকটে। আন্তর্জাতিক বাজারে অসম প্রতিযোগিতা ও দেশের বাজারে উৎপাদন কমাসহ বিভিন্ন সংকটে পড়েছে দেশের চিংড়ি খাত।
পোশাকশিল্পের পরেই ছিল এ খাতটির অবস্থান। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঘনঘন উপকূল এলাকায় বন্যার ফলে প্রতিবছর চিংড়ি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে দেশে উৎপাদিত চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হিমায়িত চিংড়ি শিল্প। গত ৭ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে রপ্তানি। ফলে বিগত দিনে খাতটি দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বর্তমানে সপ্তম স্থানে নেমে এসেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজার দখল করে নিয়েছে বেনামি প্রজাতির চিংড়ি। এতে দেশে উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ির বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০২১ পর্যন্ত এ সাত বছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির দখল ৪ শতাংশ কমে গিয়ে দুই শতাংশে নেমেছে। এ সময়ে ধারাবাহিকভাবে চিংড়ি রপ্তানি ৩৩ শতাংশ কমে যায়। একই সময়ে চিংড়ির উৎপাদনও ২৮.৩৫ শতাংশ কমে যায়।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬০ হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩০ হাজার ৮০০ টন। অন্যদিকে মৎস্য অধিদপ্তর এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৬৩৫ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এতে আয় হয় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। তবে এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে রপ্তানি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৩৬ টন চিংড়ি রপ্তানি করে আয় করে ৩৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৮০০ টন চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয় হয় ৩৮ কোটি ৮৮ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১.১৫ শতাংশ কম।
ইপিবি’র সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্য কমিয়ে আয় ধরা হয়েছিল ৩৩ কোটি ডলার। যদিও এবার রপ্তানি এবং বিশ্ববাজারে চাহিদাও কিছুটা বেড়েছে বলে দাবি রপ্তানিকারকদের। গত বছরের তুলনায় এবার ৮ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে বলে দাবি করছে চিংড়ি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিএফএফইএ। তবে তুলনামূলক এ বছরও চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ এমনটাও বলছেন তারা।
এদিকে বেনামি প্রজাতির চিংড়ি অল্প পরিশ্রম ও কম খরচে বেশি উৎপাদন করা যায়। এর জন্ম ভিয়েতনামে হলেও বিচরণ এশিয়ার সব দেশেই। বিশ্বের চিংড়ির বাজার এখন বেনামির দখলে। উৎপাদন খরচ কম, তাই দামও একটু কম। ফলে অল্পদিনেই এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্ববাজারে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৬২টি দেশ বাণিজ্যিকভাবে বেনামি চিংড়ি চাষ করে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে রপ্তানি করছে। আর এশিয়ার ১৫টি চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বাদে বাকি ১৪টি দেশই বেনামি চিংড়ি চাষ করে রপ্তানি করছে।
এদিকে উচ্চফলনশীল বেনামি চাষে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভাইরাসের ভয়ে যথাসময়ে অনুমোদন না দেয়ায় চিংড়ি রপ্তানিতে পতন ঘটেছে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজনে বেশি দেখানোর জন্য চিংড়িতে অপদ্রব্য ঢুকিয়ে (পুশ) রপ্তানি করে, যা দেশের বাজার নষ্ট করছে।
এ বিষয়ে বিএফএফইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম হুমায়ুন কবির জানান, দেশে বেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষে সম্ভাবনা রয়েছে। এ চিংড়ি উৎপাদন খরচ কম। ইতোমধ্যে এটির পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই বেনামি চাষের আবেদন করে আসছি। ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলক চাষের অনুমোদন দিলেও করোনার কারণে এটি আর শুরু করা যায়নি। তবে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাংকক থেকে ১০ লাখ বেনামির পোনা এনে পাইকগাছায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে লোনা পানি কেন্দ্রে ৬টি পুকুরে পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়। পরীক্ষামূলক চাষে ফলাফল অনেক ভালো বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, চিংড়ি রপ্তানিকারকদের নিয়েও চাষিদের আছে নানা অভিযোগের জায়গা। বছরের তিন মাস সমুদ্রে মা চিংড়ি আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় হ্যাচারিগুলো মা চিংড়ি পাচ্ছে না। চাষিদের কাছেও প্রয়োজনমতো চিংড়ি পোনা পৌঁছায় না। তাই উৎপাদন কমে গেছে অনেকাংশে। কিন্তু এ খাতকে ধরে রাখতে হলে বা আগের অবস্থান ফিরে পেতে হলে রপ্তানি বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বাড়াতে হবে উৎপাদনও।