Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 2:53 pm

উৎপাদন খাতের নতুন ঋণে সুদহার এক অঙ্ক

শেখ আবু তালেব: ঋণের সুদহার এক অঙ্কে অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শুধু উৎপাদন খাতের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে এই ঋণ বিতরণ করা যাবে। গতকাল এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।

ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংকই তা বাস্তবায়ন করেনি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে লিখিত নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে সরকার। এতে কোনো ব্যাংকই ১০ শতাংশের নিচে ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করতে পারবে না।

সুদহার-সংক্রান্ত বোর্ডসভার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডসভায় অনুমোদন হয়েছে। উৎপাদনশীল খাতে শুধু এই ঋণ বিতরণ করা যাবে। এই সুদহারে ঋণের সঙ্গে চলতি মূলধনও নিতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।’

পুরোনো ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই সুদহার প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু নতুন ঋণের ক্ষেত্রে এই সুদহার প্রযোজ্য হবে। আগামী বছরের (২০২০ সালের) ১ জানুয়ারি থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’

আগামীকাল এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। ফলে এখন থেকে উৎপাদনশীল খাতে ১০ শতাংশের নিচে সুদহারে ঋণ দিতে বাধ্য হবে ব্যাংকগুলো। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার বেঁধে দিলে ব্যাংক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, উচ্চ হারের খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট রয়েছে। এখন কম সুদে ঋণ বিতরণে অনীহা প্রকাশ করবেন ব্যাংকাররা। শুধু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা এই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। আবার পুরোনো ঋণ পরিশোধে নতুন করে কম সুদে ঋণ নেবেন। এসব ঋণ ফের খেলাপিতে পরিণত হবে। এতে সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদহার-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলার রয়েছে। এই সার্কুলার অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সুদহার নিজেরাই ঠিক করবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শুধু অবহিত করবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এটি করা হয়েছিল। এখন নতুন সিদ্ধান্ত ওই সার্কুলারের সঙ্গে কন্ট্রাডিক্ট হবে।’

এর প্রভাব সম্পর্কে প্রবীণ এই ব্যাংকার বলেন, খেলাপি ঋণ এখনও বেশি অনেক ব্যাংকের। তাদের প্রভিশনও রাখতে হচ্ছে বেশি। এই সিদ্ধান্তের ফলে ওইসব ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশের নিচে ঋণ প্রদান কার্যক্রমে বেশি এগোবে না। এতে সমগ্রিকভাবে ব্যাংকঋণ বিতরণ কমে যেতে পারে।

জানা গেছে, ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা ডাকা হয়। গতকাল বিকাল থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চলে বৈঠক। বৈঠকে সুদহার-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। সরকারের ইচ্ছায় সুদহার পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেন পরিচালকরা।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খুব দ্রুতই সার্কুলারের মাধ্যমে সব ব্যাংককে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সার্কুলার জারি করবে।

সূত্রমতে, মুক্তবাজার অর্থনীতির আলোকে সুদহার বাজারের চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভরশীল। এটি বেঁধে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশও মুক্তবাজার অর্থনীতিকে অনুসরণ করে। ব্যবসায়ীদের দাবিদের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংক উদ্যোক্তারা গত বছরের এপ্রিল মাসে সরকারের কাছ থেকে পাঁচটি সুবিধা নেয়। এর মধ্যে রয়েছে সিআরআর এক শতাংশ কমিয়ে আনা ও সরকারি আমানতের পঞ্চাশ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা। কিন্তু দেড় বছরের বেশি সময় পার হলেও ব্যাংকগুলো এটি বাস্তবায়ন করেনি।

এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছিল সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য। কিন্তু এ বিষয়ে লিখিত কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি কোনো পক্ষ থেকে। এ জন্য এটি বাস্তবায়ন করেনি বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংক। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এটি বাস্তবায়ন করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপরীতে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিপক্ষেও অধিকাংশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভায় ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়ে একক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনীহা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাবের কোনো দায় নিতে রাজি হননি কেউ। সর্বশেষ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালকরা এটির অনুমোদন করেন। নতুন এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের দ্বিতীয় প্রজšে§র এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমানত যদি না পাওয়া যায়, তাহলে এক অঙ্কে ঋণ কীভাবে বিতরণ করব। আমরা বলেছিলাম, আমানতের জোগান দিতে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত দিলে আমাদের মানতে হবেই। কিন্তু ঋণ কতটুকু বিতরণ করা যাবে, তা নির্ভর করবে কম সুদে পাওয়া আমানতের ওপর।’

এদিকে এক অঙ্কে সুদহার নামিয়ে আনতে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্যাংকাররা। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি আমানত মেয়াদির পরিবর্তে চলতি হিসাবে রাখা। অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ব্যাংকে রাখা অর্থের বিপরীতে কোনো সুদ দেবে না ব্যাংকগুলো। এই অর্থ দিয়েই তারা সরকারের অগ্রাধিকার খাতে এক অঙ্ক সুদে ঋণ দেবে।

সূত্র জানিয়েছে, গতকালের বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে প্রচলিত হারে সুদ দিয়েই ব্যাংকগুলোকে এই অর্থ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত রয়েছে ১১ লাখ ছয় হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এই আমানতের প্রায় ২৪ শতাংশ হচ্ছে সরকারি।

উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এর বাইরে পুনঃতফসিল ও রাইট অফ মিলিয়ে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য খেলাপি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এগোচ্ছে।