রহমত রহমান: রেয়াতি সুবিধায় আমদানি হচ্ছে কাঁচামাল। সে কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদন হচ্ছে কম। বাকি কাঁচামাল মূল্য ঘোষণা না দিয়ে সরাসরি বিক্রি করা হচ্ছে খোলাবাজারে। মানা হচ্ছে না রেয়াতি সুবিধার শর্ত। মূলত রাজস্ব ফাঁকি দিতেই প্রতিষ্ঠান শর্ত ভঙ্গ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়ে আসছে। ডলার সংকটের মধ্যেও ব্যাংক এলসি খুলছে। সেই কাঁচামাল প্রতিষ্ঠান খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। গাজীপুরের স্টার ইউভিপিসি পাইপ অ্যান্ড ফিটিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি সংস্থা বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠান কোথায়, কাদের কাছে কাঁচামাল বিক্রি করে, তার প্রমাণ পেয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন যাচাই করে প্রাথমিকভাবে আমদানির সঙ্গে উৎপাদনের মিল পায়নি। এক মাসে অন্তত ২০টি চালানে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি হলেও তার বেশিরভাগ উৎপাদনে ব্যবহƒত না হয়ে খোলাবাজারে চলে গেছে বলে কর্মকর্তারা তথ্য পেয়েছেন। তদন্ত শেষে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে।
সূত্রমতে, এনবিআরের একটি সংস্থা অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি, উৎপাদন ও খোলাবাজারে বিক্রির বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। ওই সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, স্টার ইউপিভিসি পাইপ অ্যান্ড ফিটিংস লিমিটেড গত কয়েক মাসে যেসব পণ্য আমদানি করেছে, তা যাচাই করা হচ্ছে। বিল অব এন্ট্রি যাচাইয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি রেয়াতি সুবিধায় (ভি১১) কাঁচামাল আমদানি করে আসছে। গত কয়েক মাসে কাঁচামাল হিসেবে বিপুল পরিমাণ পিভিসি রেজিন আমদানি করেছে। এছাড়া পলিভিনাইল ক্লোরাইড, পলিপ্রোফাইলিন, পিপি ইয়ার্ন, পলিইথিলিন, এইচডিপিই ফ্লিম, এলএলডিপিই ফ্লিম, ফ্যান বা ওয়াটার পাম্প মটর ইত্যাদি আমদানি করেছে। এক মাসে অন্তত ২০টি চালানে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, যা উৎপাদনে ব্যবহƒত হয়নি বলে অভিযোগ পেয়েছি। ভি১১ সুবিধার অর্থ হলো, প্রতিষ্ঠান আগাম কর (এটি) ছাড়াই পণ্য আমদানি করতে পারবে। শর্ত হলো, কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে বিক্রি করতে হবে।
সরাসরি কাঁচামাল বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে কোনো পণ্য তৈরি করছে না। সরাসরি তা খোলাবাজারে বিশেষ করে পুরান ঢাকার উর্দু রোডে বিক্রি করে আসছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানের আমদানি যাচাই করে দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে প্রচুর পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করেছে। ভ্যাট কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন যাচাই করে দেখা গেছে, আমদানি করা কাঁচামালের পরিমাণ অনুযায়ী পণ্য তৈরি হচ্ছে না। আমদানি অস্বাভাবিক। রেভিনিউ কম দিচ্ছে। ১২ লাখ, ১৩ লাখ, ৩১ লাখ টাকা ….এমন রেভিনিউ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠান। আমদানির সঙ্গে উৎপাদন ও রেভিনিউ কোনো মিল নেই। প্রতিষ্ঠান আমদানি করা কিছু কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদন করছে। বাকি কাঁচামাল মূল্য ঘোষণা, অনুমোদন না নিয়ে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা প্রতিষ্ঠান থেকে কাগজপত্র এনে আরও যাচাই করব। তবে যাদের কাছে কাঁচামাল বিক্রি করা হয়েছে, হচ্ছে-আমরা তাদের তথ্য পেয়েছি। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে, ডলার সংকটের মধ্যেও দুইটি ব্যাংক দুইটি প্রতিষ্ঠানকে দেদার এলসি খুলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল বিক্রি করে ওই ব্যাংকের দেনা শোধ করছে। ব্যাংকের সহযোগিতায় এই কাঁচামাল বিক্রি করা হচ্ছে। ট্রেডিং বিজনেসের নামে উৎপাদন না করে রেয়াতি সুবিধার কাঁচামাল ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হচ্ছে। পুরান ঢাকার জামির এন্টারপ্রাইজ, এম জে প্লাস্টিক, শহীদুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, অর্কিড প্লাস্টিক, শাহেদ ইন্টারন্যাশনাল, মায়মুনা এন্টারপ্রাইজ, সামাদ এন্টারপ্রাইজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কাঁচামাল বিক্রি করে স্টার ইউভিপিসি পাইপস অ্যান্ড ফিটিং লিমিটেড।
এ বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক শাহীন রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, স্টার ইউপিভিসি পাইপ অ্যান্ড ফিটিং লিমিটেড নয়, স্টার পাইপস অ্যান্ড প্লাস্টিক লিমিটেড আমাদের ক্লায়েন্ট। সম্প্রতি বা গত দুই মাসে এই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো এলসি খোলা হয়নি বলে জানান তিনি। অপরদিকে, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড মৌলভীবাজার শাখা ডলার সংকটের মধ্যেও এই প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওই শাখা ব্যবস্থাপক জসিম আহমেদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
রেয়াতি সুবিধার কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাকের হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা তো বন্ডের মাল ইম্পোর্ট করি না। আমরা ট্যাক্স দিয়ে মাল আনি। এটা তো বন্ড না।’ রেয়াতি সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করে কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা উৎপাদনও করি। বাজারে বিক্রি করি না। আপনাকে যে তথ্য দিয়েছে সে ভুল তথ্য দিয়েছে।’
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষ হয়ে শেয়ার বিজের সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলেন ফারদিন গ্রæপের লিগ্যাল অফিসার এম টি আর রুবেল। তিনি প্রশ্ন করেন, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কি কাঁচামাল বিক্রি করতে পারে? যেসব প্রতিষ্ঠানে আমরা বিক্রি করি, তারা কি আপনার কাছে কোনো পেপার্স দিয়েছেন? আমার তো ট্রেডিং বিজনেস রয়েছে। আমি কি বিক্রি করতে পারি না? রেয়াতি সুবিধার শর্ত মেনে বিক্রি করা হয়েছে কি নাÑএমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, যাদের কাছে আমরা বিক্রি করি বলে আপনি তথ্য পেয়েছেন, তাদের থেকে বিক্রির ডকুমেন্ট নিয়ে আপনি কথা বলেন। আমরা রেয়াতি সুবিধার কাঁচামাল বিক্রি করি না। এক কথায় না। রেয়াতি সুবিধা নিয়ে আমরা কখনও বিক্রি করতে পারি না। অবশ্যই না।
অপরদিকে, স্টার ইউপিভিসি পাইপ অ্যান্ড ফিটিংস লিমিটেড রাজধানীর পুরান ঢাকার উর্দু রোডে খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রি করে দেয় বলে স্বীকার করেছেন সেখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ও ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেছেন, ‘স্টার ইউভিপিসি পুরো মার্কেট খারাপ করে দিয়েছে। কম দামে বাজারে কাঁচামাল বিক্রি করে দেয় এই প্রতিষ্ঠান। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া এই কাঁচামাল কম দামে বিক্রির ফলে আমরা সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত।’ তাদের কাছে বিক্রি করা কাঁচামালের প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন।