উৎপাদন বন্ধ থাকলেও দিতে হবে পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ!

ইসমাইল আলী: জ্বালানি সংকটে গত জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং শুরু হয়। এর আগে ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার তথ্য জানানো হয়। জ্বালানি সংকটে ওই সময় বেশকিছু রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা থাকলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না তেলভিত্তিক বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে চুক্তির শর্তের কারণে বেসরকারি এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পুরোটাই দিতে হবে। এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গচ্চা যাবে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।

সূত্র জানায়, ডলার সংকটে চলতি অর্থবছর বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারেনি। ফলে জ্বালানি তেল সংকটে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে আংশিক উৎপাদন হয়। এছাড়া সরকার ভর্তুকির অর্থ নিয়মিত ছাড় না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। গ্যাস সংকটেও বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা যাবে না।

চুক্তি অনুযায়ী, বছরে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে পারে রেন্টাল ও আইপিপিগুলো। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ সময় উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত রাখতে হয় কেন্দ্রগুলো, যাতে পিডিবি চাহিদা দেয়া মাত্র তারা উৎপাদন করতে পারে। তাই ৯০ শতাংশ সময় সরকার বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। তবে কোনো কারণে কেন্দ্র বন্ধ থাকলে বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত না থাকলে সরকার কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ কাটতে পারবে।

তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জ্বালানি তেল সংকটের কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে ৩০-৪০ শতাংশ উৎপাদন করেছে। আর ১০ শতাংশ সময় স্বেচ্ছা বন্ধ রাখার শর্ত ছিল। অর্থাৎ বাকি ৫০-৬০ শতাংশ সময় উৎপাদন বন্ধ ছিল বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের। যদিও এজন্য কেন্দ্রগুলোকে কোনো ধরনের জরিমানা করতে পারবে না পিডিবি। কারণ চুক্তিতেই এ বাড়তি সুযোগ দেয়া আছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনহীন বন্ধ রাখা ও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না দিতে পারার জন্য গত সেপ্টেম্বরে রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পিডিবি। তবে পিডিবির এ সিদ্ধান্তে আপত্তি জানায় বিপ্পা (বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস’ অ্যাসোসিয়েশন)। ওই সময় বিপ্পা জানায়, চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসের বিল পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে মালিকরা চাইলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে পারবে। এজন্য কোনো ধরনের জরিমানা বা ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা যাবে না। বিপ্পার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয় পিডিবি।

প্রথমে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। তবে ডলার সংকট না কাটা ও ভর্তুকি নিয়মিত না পাওয়ায় এখনও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিল নিয়মিত দিতে পারছে না পিডিবি। ফলে পরে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আরও ছয় মাসের জন্য বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে ছাড় দেয়া হয়। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ের জন্যই ছাড় পাচ্ছে আইপিপি ও রেন্টালগুলো।

পিডিবির হিসাবমতে, বর্তমানে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা প্রায় ছয় হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে গড়ে ৬০ শতাংশ বন্ধ রাখলে তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্র বসে ছিল। ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে এসব কেন্দ্রের দুই হাজার ৮৮০ মেগাওয়াট ব্যবহার করা যাবে। এসব কেন্দ্রের জন্য প্রতি কিলোওয়াটে গড়ে ১০ ডলার হিসেবে এক বছরে বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বা ৪৩ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার = ১০৭ টাকা)।

জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অর্থ সংকট ও নিয়মিত ভর্তুকি না পাওয়ায় অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ এখনও পরিশোধ করা যায়নি। তবে পুরোটাই পিডিবিকে পরিশোধ করতে হবে। বরং ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলে এ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাবে।

তথ্যমতে, গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১৬ নভেম্বর বিপ্পা থেকে পিডিবিতে দুটি চিঠি দেয়া হয়। এগুলোয় জানানো হয়, নির্ধারিত তারিখের মধ্যে বিপ্পা সদস্য কোম্পানিগুলোর মাসিক বিল পরিশোধে পিডিবি ব্যর্থ হয়। পিপিএ (বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি) অনুযায়ী পিডিবি থেকে এলসি প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারেনি। ফলে রেশনিং করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে হয়েছে। এজন্য ১ মে বিপ্পা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আউটেজ (উৎপাদন বন্ধ রাখা) গণনা বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হয়েছিল।

চিঠিতে আরও বলা হয়, পিডিবি ও বিপ্পার সদস্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত পিপিএর সেকশন ১৩.২ (জে) অনুযায়ী, কোম্পানি কর্তৃক মাসিক বিল দাখিলের ৩০ দিন পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পিডিবি বিল পরিশোধ না করলে কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহে বাধ্য থাকবে না। সেক্ষেত্রে ওই সময়ে কোম্পানি পূর্ণ ক্যাপাসিটি চার্জ প্রাপ্য হবে।

বিপ্পার আবেদন পর্যালোচনা করে পিডিবি জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে পিডিবি থেকে আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় এ কোম্পানিগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে এবং জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এলসি খোলা ও সেটেলমেন্টে বিলম্ব হওয়ায় অধিক সুদের হার আরোপিত হচ্ছে। এছাড়া যথাসময়ে নতুন করে এলসি খোলাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আউটেজে (১০ শতাংশের বেশি সময় উৎপাদন বন্ধ) পড়তে হচ্ছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনায় শুধু ফার্নেস অয়েলচালিত সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জুলাই ’২২ থেকে ডিসেম্বর ’২২ পর্যন্ত অতিরিক্ত আউটেজের বিপরীতে লিকুইডেটেড ডেমারেজ না কাটা বা অ্যাভেইলেবল ফ্যাক্টর বিবেচনায় ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস না করার সাময়িক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে ডলার সংকট এখনও কাটেনি। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিলও নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তাই ডেমারেজ না কাটার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০