মো. মাঈন উদ্দীন:‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়, ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’ বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২-এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ওই বাক্যগুলো। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়। করোনা মহামারি-পরবর্তীতে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা, গবেষণা, পর্যালোচনা চলছে। কারণ খাদ্য সংকটকে কেন্দ্র করে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিল তা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা যে কতটা দুরূহ ও কঠিন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত পরিবেশ, উন্নত জীবন, সুন্দর ও টেকসই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবারের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পালে মানবিক বিপর্যসহ নানা ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। তাই উন্নত জীবন, উত্তম পুষ্টি, পরিবেশ সুরক্ষা, মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি ও কৃষি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখনও ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। আমাদের দেশের উর্বর মাটি, কৃষি ও খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য অনুকূল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এ দেশে। শুধু ধান ও গম উৎপাদনে নয়, মাছ, সবজি, পশু পালন, মাংস উৎপাদন, আলু উৎপাদন, নানা ধরনের ফল, সবজিসহ পোলট্রি খাতেও উৎপাদনে বাংলাদেশ অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। এসব খাতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য থেকে দেখা যায়, ধান উৎপাদন, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ ও ছাগলের মাংস উৎপাদনে সপ্তম অবস্থান রয়েছে। পোলট্রি ও ডিম উৎপাদন করে মানুষের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বার্ষিক ডিম উৎপাদন ১ হাজার ৭০০ কোটি পিচ। কলা চাষেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। ইদানীং স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও পেয়ারার ভালো ফলন হচ্ছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম এবং বছরে এই দেশে আলু উৎপাদন হয় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। পুষ্টিকর খাদ্য দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন হয় এক কোটি ৬৮ লাখ টন। মাংস উৎপাদন হয় ৭৬ টন। উৎপাদনের এই অবস্থানকে আরও বৃদ্ধি ও গতিশীল করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। কৃষি ও কৃষি জাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত না রাখলে সংকট আরও ভয়াবহ হতে পারে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ হলেও দেশে চালের উৎপাদন বাড়েনি। বিশেষজ্ঞরা আগামী বছর খাদ্য সংকটের যে আবাস দিয়েছেন সেটা মোকাবিলা করতে হলে চালের মজুত বাড়াতে হবে। ধান উৎপাদনসহ কৃষিসামগ্রী ও শাকসবজি উৎপাদন বাড়াতে হবে। মৎস্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমতির দিকে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে ব্যাপকভাবে খাদ্যঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক তথ্য থেকে জানা যায়, বাইরে থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে খাদ্যঘাটতি বড় সংকটের আকার নেবে। মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। আমাদের যে প্রচুর আবাদি জমি আছে তা সঠিক ব্যবহার করার পাশাপাশি অনাবাদি জমিগুলোও আবাদযোগ্য করে উৎপাদন কাজে লাগাতে হবে। কৃষি এখনও আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে কৃষি ও কৃষকেরা সুরক্ষা পায় সেদিকে জোর নজর দিতে হবে। কৃষি থেকে আসে শিল্পের কাঁচামাল। কৃষি উৎপাদন বিঘিœত হলে খাদ্য সংকট ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বলানি সংকট আরও গভীর হতে পারে। দীর্ঘদিন জ্বলানি সংকট থাকলে খাদ্য উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদনসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতের সংকট তৈরি হবে। বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, সংকুচিত মুদ্রার মান বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকটকে আরও গভীর করতে পারে। বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি সংকোচিত মান খাদ্য ও জ্বালানির দাম এমনভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে তা খাদ্য ও জ্বালানি সংকটকে আরও গভীর করতে পারে। জ্বালানি পণ্যের উচ্চ মূল্য যা কৃষি উৎপাদন ইনপুট হিসেবে কাজ করে খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি আরও দীর্ঘ দিন চলমান থাকে তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার চ্যালেঞ্জকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। কৃষকেরা কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে পান না। কৃষিতে মুনাফা কম হওয়ায় নতুন প্রজš§ এ খাতে আসতে চায় না। এ পেশার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকে পেশা হিসেবে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। কৃষকেরা তাদের সন্তানদের এ পেশায় আনতে উৎসাহী নন। বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। এ খাতে কৃষকের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। কৃষক প্রয়োজনীয় সার, বীজ ও কীটনাশক ব্যবহার করে যেন লাভের মুখ দেখতে পায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কৃষি খাতে ব্যবহƒত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট দূর করতে হবে। কৃষিঋণ সহজলভ্য করাসহ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাঠ পর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে। কৃষি পেশায় লোকবলের সংকট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে খাদ্য সংকট আরও তীব্রতর হবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বিবিএস সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। সেচের আওতায় ৭৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর, পতিত ২ লাখ ২৩ হাজার, এক ফসলি জমি ২২ লাখ ৫০ হাজার, ২ ফসলি জমি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ও ৩ ফসলি জমির পরিমাণ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর। কৃষি গবেষকদের মতে, দেশে যে বিশাল আবাদযোগ্য জমি রয়েছে তা যদি পরিকল্পিতভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় তাহলে বৈশ্বিক এ মন্দাতেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান আরও বাড়ানো সম্ভব। কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকার হলো সার। শিল্প করপোরেশন সূত্রে যানা গেছে, দেশে মোট ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৮ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১০ লাখ টন, বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে। বেশি দামে সার আমদানি করে কম দামে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। যদিও কৃষি খাতে এই ভর্র্তুকি কতটা কৃষক পান তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়ার জন্য ফল-ফলাদি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, গম ও ভুট্টা উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ডিম ও মুরগি সরবরাহের উন্নত খাত পোলট্রি খাতের উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। কৃষির উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়ন ও এ খাতের শ্রমিকদের কথাও ভাবতে হবে। কৃষদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বাজারব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে কৃষিসামগ্রী, সবজি ও ফলমূলকে জনগণের মাঝে সহজলভ্য করতে হবে। দেশে কর্মসংস্থান সংকট দূরীকরণে কৃষি পেশাকে বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে কৃষিপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ সহজীকরণ ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন প্রজš§কে কৃষিতে আগ্রহী করতে হবে। কৃষি খাতে চলমান সংকট ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তার সমাধানের ব্যবস্থা করলে উৎপাদনকে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতিও ক্রমান্বয়ে কমে আসবে।
মাঈন উদ্দীন
main706@gmail.com