নাজমুল হুসাইন: সম্প্রতি দেশে নতুন পাট আইন করা হয়েছে। এছাড়া ১৯টি পণ্যের সরবরাহ ও বিপণনে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাটপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, রফতানি বৃদ্ধিসহ বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। কিন্তু পাটের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নেতিবাচকই রয়ে গেছে। বীজ সংকট থেকে শুরু করে আবাদি জমি হ্রাস, পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার মতো নানা জটিলতায় এখন পাটে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে কৃষক। এ অবস্থায় পাটের ব্যবহার ও বাজারজাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবাতাস লাগলেও উৎপাদন স্থবিরতা বড় বাধা হয়ে রয়েছে।
দেশে পাটের উৎপাদন নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সত্তরের দশকে পাটের সুদিন ছিল। সে সোনালি সময়ের পরে শেষ ২০১০-১১ সময়ে দেশে তুলনামূলক পাটের উৎপাদন বেশি ছিল। তবে এর পর থেকে আবারও উৎপাদন ক্রমাগত কমছে। ২০১০-১১ সময়ে দেশে ৮৩ লাখ ৯৬ হাজার বেল পাট উৎপাদন হয়েছিলো, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা ৭৫ লাখ ৬০ হাজার বেলে নেমে এসেছে। একইভাবে ২০১১-১২ সময়ে দেশে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার একর জমিতে পাট চাষ হতো, তা এখন নেমেছে ১৬ লাখ ৬২ হাজার একরে।
এ অবস্থায় আজ দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় পাট দিবস পালিত হচ্ছে। ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ/পাটপণ্যের বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে দেশজুড়ে দিবসটি পালনে নানা আয়োজন থাকছে। এখন থেকে প্রতি বছর এই দিনকে পাট দিবস পালনের প্রস্তাব মন্¿িসভায় অনুমোদিত হয় গত ৩০ জানুয়ারি। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করে মন্¿িপরিষদ বিভাগ।
আগামী ৯ মার্চ রাজধানীর খামারবাড়ীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে দিবসের মূল অনুষ্ঠান ও ৯ থেকে ১১ মার্চ পাটপণ্যের মেলা আয়োজন করা হবে। প্রধানমন্¿ী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। এদিকে দিবসটি উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাট ও পাটজাত পণ্য সহযোগে বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। প্রচারের জন্য ব্যাপক সংখ্যক পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার ও বিল বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে এ মাসের শুরু থেকেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন খাতে বীজ থেকে শুরু করে পাট বিক্রি পর্যন্ত নানা সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে বীজের সংকট, পাট পচন পদ্ধতিসহ পানির সংকট বর্তমানে তীব্র হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. চন্দন কুমার সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে বর্তমানে প্রতি বছর পাটবীজের প্রয়োজন ৫ হাজার ৫০০ টন। সেখানে দেশে স্থানীয়ভাবে মাত্র ১ হাজার ২০০ টন বীজ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় জোগান খুবই নগণ্য। বাকি বীজের জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এর পরও যে বীজ পাওয়া যাচ্ছে, তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অপরদিকে বিজেআরআইর প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার ড. আলমগীর সাঈদ বলেন, পানি ও পানিতে বসবাসকারী অসংখ্য জীবাণুর মিলিত প্রচেষ্টায় পাট গাছের বাকল থেকে আঁশ পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়াকে পাট পচন প্রক্রিয়া বলা হয়। ভালো বীজ যেমন ভালো গাছের পূর্বশর্ত, তেমনি পাট আঁশের গুণাগুণ অনেকাংশে পাট পচনের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। পাট আঁশের গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে পাটের গ্রেডিং করা হয়। পাট পচন পদ্ধতি যদি সঠিকভাবে না হয়, তাহলে এর গ্রেড কমে যাবে। কৃষকরা সঠিক দাম পাবেন না। দেশে অনেক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি থাকলেও সেসব প্রয়োগ কম। এছাড়া বর্তমানে পাট পচনে জলাশয় ও পানির অভাব বাড়ছে।
এদিকে দেশে বিগত সময়ে পাটের দাম পাননি কৃষকরা। বর্তমানে দাম কিছুটা বাড়লেও উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ খরচ বৃদ্ধির তুলনায় তা খুবই কম। এতে অনেক কৃষকই পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এমনটা জানিয়ে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মোকদ্দখোলা গ্রামের পাটচাষি ওহিদ মোল্যা বলেন, প্রতি ১০০ আঁটি পাট কেটে মাঠ থেকে নদীতে ফেলতে তার ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা গুনতে হয়েছে। এরপর জাগ (পচন প্রক্রিয়া) দিয়ে পাট ছাড়িয়ে ধুয়ে শুকিয়ে ঘরে তুলতে লেগেছে আরও ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। সব মিলিয়ে ১০০ আঁটি পাট ঘরে তুলতে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বাজারদর ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে ১০০ আঁটি পাটের দাম হয় ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকার মতো। ফলে পাটের বর্তমান দামও লাভজনক নয়।
এদিকে পাটের উৎপাদনে স্থবিরতার পরেও বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে দ্রুত। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার বা প্রায় ৪ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, যা এ সময়ের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় এ খাতের পণ্য রফতানি আয় ১৪ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ বেড়েছে।
রফতানি বাজার নিয়ে ক্রিয়েশন (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম বলেন, ১৫ বছর ধরে বিশ্বে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) দ্রব্যের চাহিদা বাড়ছে। প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চাহিদা বাড়ছে। গতানুগতিক পণ্যের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এখন ওয়াল কাভারিং, হোম টেক্সটাইল, হাউজহোল্ড প্রোডাক্টস, লাইফস্টাইল, ফুটওয়্যার ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া সারা বিশ্বে ৫০০ বিলিয়ন বাজারের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র কয়েক শতাংশও যদি আমরা সরবরাহ করতে পারি, তাহলে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি। আশার কথা হলো, সরকার এখন পাট নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালেদ বলেন, বর্তমান সরকার সব পাটকল চালু করেছে। এতে পাটশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন বিভাগে ১২ কোটি ৭০ লাখ বর্গমিটার উন্নত ধরনের চট (জুট জিও টেক্সটাইল) লাগে। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন এর সম্পূর্ণটাই উৎপাদন করতে পারে।
তিনি বলেন, চটের ব্যবহার নিশ্চিতে সরকার পরিকল্পনা করেছে। এখন এটি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশীয় চটের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এখান থেকে বছরে ৮৫ মিলিয়ন ডলার আয় হবে। পাট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসহ সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
Add Comment