Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:05 am

উৎসে করের কারণে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ার শঙ্কা

ইসমাইল আলী: নিজস্ব কেন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বেশি দামে কিনে কম দাম বিদ্যুৎ বিক্রি করায় প্রতি বছর বাড়ছে সংস্থাটির লোকসানের বোঝা। গত জুন পর্যন্ত পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এরপরও পিডিবির ওপর চাপানো হয়েছে ৬ শতাংশ উৎসে আয়কর। চলতি অর্থবছর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন অর্থ আইনে এ করারোপ করা হয়েছে।

নতুন করে উৎসে আয়কর আরোপের ফলে সংস্থাটির লোকসানের বোঝা বাড়বে বলে মনে করছে পিডিবি। আর সে লোকসান কমাতে বাড়াতে হবে বিদ্যুতের দাম। যদিও এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৯ বার। তাই উৎসে আয়কর মওকুফের আবেদন করেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে এ আবেদন করা হয়। পাশাপাশি চিঠির অনুলিপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানির প্রধানদের দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, পিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে আইপিপি, রেন্টাল ও সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পনি এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিভিন্ন বিতরণকারী কোম্পানি বা সংস্থার কাছে বিক্রি করে। উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে বিইআরসি কর্তৃক নির্ধারিত হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রি করায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে। ২০২১ সালের ৩০ পর্যন্ত পিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৬৫০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

এদিকে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৫২এন ধারা অনুযায়ী, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার সময় এর মূল্য পরিশোধের ওপর ৬ শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তন ও তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার শর্ত ছিল। তবে ১৯৯৯ সালের ২৭ মে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ১৫ বছরের জন্য কর অব্যাহতি দেয়া হয়। সে অনুযায়ী যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে, সেগুলো থেকে উৎসে আয়কর কর্তন করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হচ্ছে।

যদিও অর্থ আইন-২০২১-এ ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৫২এন ধারাটি প্রতিস্থাপন করা হয়। এ সময় বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির সময়ও ছয় শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তন ও তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার বিধান করা হয়। তবে কোনো কোম্পানির কর অব্যাহতি থাকলে তা পৃথক আবেদন পত্রে উল্লেখের বিধান রাখা হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বাল্ক (পাইকারি) বিদ্যুৎ বিক্রির সময় বিলের ওপর ছয় শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কর্তনের জন্য পিডিবিকে অনুরোধ করা হয়। অন্যথায় পিডিবির বাল্ক বিলের ওপর ছয় শতাংশ হারে আয়কর কর্তন করা হবে বলে বিভিন্ন বিতরণকারী কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর।

চিঠিতে আরও বলা হয়, উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় প্রতি বছর পিডিবির বিপুল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় একক ক্রেতা হিসেবে পিডিবি বিধি মোতাবেক আয়করযোগ্য সব বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির বিল থেকে ছয় শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কর্তনের পর পুনরায় বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর আয়কর কর্তন করা হলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি প্রয়োজন হবে।

এ অবস্থায় বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রয় মূল্যের ওপর কোনো মুনাফা না থাকা ও পিডিবি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৫২এন ধারা অনুযায়ী বাল্ক বিদ্যুৎ বিলের ওপর উৎসে আয়কর কর্তন থেকে পিডিবিকে অব্যাহতি দেয়ার অনুরোধ করা হয়।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, পিডিবি একটি লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। আর লোকসানি সংস্থা হিসেবে কোনো ধরনের আয়কর দিতে হয় না। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী আয়করযোগ্য কোম্পানিগুলোর কর কেটে রেখে তা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়। আর বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর পিডিবির কোনো মুনাফা হয় না। উল্টো সরকারের ভর্তুকি দিয়ে লোকসানের ঘাটতি মেটাতে হয়। তাই নতুন করে উৎসে আয়কর আরোপ করলে পিডিবির লোকসানের বোঝা আরও বাড়বে। আর তা পূরণে সরকারের ভর্তুকি বাড়াতে হবে অথবা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে হবে। তাই উৎসে আয়কর অব্যাহতি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। আশা করি, এনবিআরের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করবে বিদ্যুৎ বিভাগ।

উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পিডিবির লোকসান হয়েছে ৯ হাজার ২০৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। জুন শেষে তা রেকর্ড ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও গত অর্থবছরের হিসাব এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি।

এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয় সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮৩ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছর ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ২০১০-১১ অর্থবছরে চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।