ঊর্ধ্বমুখী বাজারে বাড়ছে ইনসাইডার ট্রেডিং: ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ বিনিয়োগকারী

নিয়াজ মাহমুদ: দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন। বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ। এ সুযোগে কিছু কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। অভিযোগ পেলে স্টক এক্সচেঞ্জ দায়সারা গোছের একটি কারণ দর্শানো নোটিস দেয়। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মেলে না সদুত্তর। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কারসাজি করে শেয়ারদর বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কোম্পানির কোনো গোপন খবর স্টক এক্সচেঞ্জ বা গণমাধ্যমে প্রকাশ না করে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করাকে সুবিধাভোগী প্রকৃত গ্রাহক (ইনসাইডার টার্নওভার নিট ক্লায়েন্ট) বলে। যদিও তালিকাভুক্ত কোম্পানির যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রথমে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। সেটি না করে প্রথমে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে প্রচার করে তারা সিংহভাগ শেয়ার কেনে। তারপর তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইতে প্রচার করা হয়। তখন সেই তথ্যে আকৃষ্ট হয়ে যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে থাকেন তখন বেশি দামে সিন্ডিকেট সেগুলো বিক্রি করতে থাকে, যা আইনত সম্পূর্ণ অবৈধ।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমানের সঙ্গে। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে সময় ও জনবলের অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করার সুযোগ হচ্ছে না।’

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দুই মাসে ৬০টি কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিক বেড়েছে। সেসব কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

এদিকে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধি পাওয়া ৬০ কোম্পানির মধ্যে ২০টিই ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি। এ ছাড়া আট কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি নিয়ে ডিএসই একাধিকবার তথ্য প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সাত কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে তদন্তে নেমেছে।

অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলো হলো ফারইস্ট ফাইন্যান্স, স্যালভো কেমিক্যাল, বারাকা পাওয়ার, কেঅ্যান্ডকিউ, সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স, মালেক স্পিনিং মিলস, মোজাফফর হোসাইন স্পিনিং মিলস, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, জিবিবি পাওয়ার, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, এ্যাপোলো ইস্পাত, আইসিবি, বেক্সিমকো, বিডি ফাইন্যান্স, বেক্সিমকো সিনথেটিকস, ন্যাশনাল টি, রংপুর ফাউন্ড্রি, আরগন ডেনিমস, নাভানা সিএনজি, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বিডি অটোকারস, ইফাদ অটোস, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস, জিপিএইচ ইস্পাত, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, শমরিতা হসপিটাল, পেনিনসুলা চিটাগং, মাইডাস ফাইন্যান্স, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, সমতা লেদার, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, গোল্ডেন সন, মেঘনা পেইটি ইন্ডাস্ট্রিজ, মেঘনা সিমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, ম্যারিকো বাংলাদেশ, আরএন স্পিনিং মিলস, ড্যাফোডিল কম্পিউটারস, এমারেল্ড অয়েল, গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, আরএসআরএম স্টিল, রহিমা ফুড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, এবি ব্যাংক, শাশা ডেনিমস, শ্যামপুর সুগার মিলস, ইমাম বাটন, জিলবাংলা সুগার মিলস, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, এইচআর টেক্সটাইল ও ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং।

এর মধ্যে ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো হলো দুলামিয়া কটন, বিচ হ্যাচারি, কেঅ্যান্ডকিউ, বেক্সিমকো সিনথেটিকস, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বিডি অটোকারস, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, মাইডাস ফাইন্যান্স, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, সমতা লেদার, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, মেঘনা পেইটি ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, আরএন স্পিনিং মিলস, রহিমা ফুড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, শ্যামপুর সুগার মিলস, ইমাম বাটন ও জিলবাংলা সুগার মিলস।

অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি নিয়ে একাধিকবার তথ্য প্রকাশ করা কোম্পানিগুলো হলো শ্যামপুর সুগার মিলস, ইমাম বাটন, জিলবাংলা সুগার মিলস, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, এইচআর টেক্সটাইল, সোনারগাঁও টেক্সটাইল ও ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং।

এদিকে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি কারণে ‘জেড’ ক্যাটাগরির সাত কোম্পানি নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। গত ৬ ডিসেম্বর বিএসইসির ৫৯২তম কমিশন সভায় এ কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কোম্পানিগুলো হলো রহিমা ফুড, ফাইন ফুডস, বিডি অটোকারস, মেঘনা পেইটি ইন্ডাস্ট্রিজ, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ, জিলবাংলা সুগার মিলস, ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ ও শ্যামপুর সুগার মিলস। এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ঋণাত্মক।

এ প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে শেয়ারের দাম বাড়ানো কিংবা তথ্য গোপন করে বা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে আইনগত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুঁজিবাজারে কারা এ ধরনের কার্যক্রম চালায়, তা চিহ্নিত করা কঠিন। যদি তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। আর সময় সময় যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে সেসব কোম্পানিকে কেন দাম বাড়ছে, কারণ জানতে চেয়ে নোটিস করা হচ্ছে।’ তদন্ত করে সেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢালাওভাবে বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে এমন কথা বলা ঠিক হবে না। কারণ এখনও অনেকে কোম্পানির শেয়ারের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক নিচেই রয়ে গেছে। তবে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে। ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের আরও হার্ডলাইনে যাওয়া দরকার বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির নেপথ্যে অবশ্যই কারণ আছে বলে মনে করেন পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গুজব ছড়িয়ে শেয়ারদর বৃদ্ধি করে হাতে থাকা শেয়ার ছেড়ে দেয় একটি অসৎ চক্র। আর এ বিষয়ে কোম্পানিকে স্টক এক্সচেঞ্জের দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিস ফরমালিটি রক্ষা ছাড়া কিছুই নয়।

এ প্রসঙ্গে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ডিএসই বা সিএসইর দেওয়া কারণ দর্শানোর উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসিত। তবে এর পাশাপাশি যদি শেয়ার লেনদেনের বিষয়টি নজরদারি করা হতো, তবে দরবৃদ্ধির নেপথ্যে যারা কাজ করছে, তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।’

তার মতে, শেয়ারবাজারে কারসাজি মূলত এভাবেই হয়। অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বাড়ানোর নেপথ্যে যারা, তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। একটি স্বাভাবিক মার্কেটের জন্য এ কাজটি আরও জোরালোভাবে করা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর তুলনায় তদন্ত খুবই কম। যদিও এসব বিষয়ে তদন্ত করে বিএসইসি অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ পেয়েছে। এমনকি জরিমানাও করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, ব্রোকার হাউজ ও কোম্পানির বিরুদ্ধে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, নির্দিষ্ট শেয়ারের দর বৃদ্ধি করে একটি চক্র ফায়দা হাসিল করছে। ফলে একটানা কোনো শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেতে থাকলে তা স্টক এক্সচেঞ্জের নজরে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয় স্টক এক্সচেঞ্জ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। এর কারণ অনুসন্ধানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নীরব।

কথা হয় বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘শেয়ারের দর বৃদ্ধির পেছনে একটি মহল সক্রিয়। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীকেই সজাগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে তদন্তের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকেও আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দেন প্রবীণ এ বিশ্লেষক।

 

ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ কঠোর অবস্থানে থাকলে বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএএম মাজেদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই বাজারের স্থায়ী যৌক্তিক, গতিশীল, স্থিতিশীলতা চাই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে আমরা সব সময়ই বলে থাকি ফান্ডামেন্টাল বুঝে জেনে বিনিয়োগ করুন। কোম্পানির ইপিএস, এনএভি, পিই রেশিও উদ্যোক্তা ইত্যাদি যাচাই করে বিনিয়োগ করুন। কোম্পানির সার্বিক বিষয়াদির পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণই বিনিয়োগের মূলমন্ত্র হতে হবে। আমরা মনে করি, একজন সচেতন বিনিয়োগকারীই বাজারের উন্নয়নের পূর্বশর্ত।’

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০