শেখ আবু তালেব: উচ্চ হারের খেলাপির ভারে ন্যুব্জ দেশের ব্যাংক খাত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বড় আমানতধারী ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে একটি গোষ্ঠী। এসব ঋণের ৮০ শতাংশের বেশিই এখন খেলাপি, যদিও পুনঃতফসিলের কারণে খেলাপি কিছুটা কম দেখাতে পারছে ব্যাংকগুলো। এরপরও বর্তমানে মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ শতাংশের বেশি রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।
তথ্য বলছে, ২০১৯ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। আর শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে রয়েছে মোট খেলাপির ৬৩ দশমিক তিন শতাংশ। এ তালিকায় রয়েছে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত, চারটি বেসরকারি খাতের ও একটি বিশেষায়িত ব্যাংক।
আবার মোট খেলাপির ৪৫ দশমিক আট শতাংশই রয়েছে শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের। অবশিষ্ট ৫৫ ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ ৫৪ দশমিক দুই শতাংশ। অর্থাৎ পাঁচটি ব্যাংকই খেলাপির সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে। বিশাল অঙ্কের অর্থ এ খাতে আটকে থাকায় ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমে আসছে। অপরদিকে চাপের মধ্যে রয়েছে ঋণ ব্যবস্থাপনা।
২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর তথ্য পর্যবেক্ষণ করে এমন প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। কিন্তু করোনা মহামারি উচ্চ হারের খেলাপিতে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এতে খেলাপি কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ও সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নও কঠিন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৬০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক কাজ করছে। কিন্তু ২০১৯ সালে ছিল ৫৯টি। এজন্য ৫৯টি ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত খেলাপি ঋণের এ পরিমাণই প্রকৃত চিত্র নয়। এসব ঋণের বাইরে খেলাপি হওয়া ঋণের বড় একটি অংশ নিয়মিত পুনঃতফসিল হয়ে আসছে। কিছু ঋণ রাইট অফ করে মূল লেজার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ মিলিয়ে খেলাপির পরিমাণ হিসাব করে আইএমএফ বলছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। শুধু রাইট অফের পরিমাণই হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
পূর্ববর্তী বছরগুলোয় ২০১৮ সালে ২৩ হাজার কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ১৯ হাজার কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে কিছুটা কমেছে পুনঃতফসিলের কারণে। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াও ঋণ নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয় বড় খেলাপিদের। অথচ নিয়ম হচ্ছে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। গত বছর মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সুদহারেও ছাড় দেওয়া হয়। অর্থাৎ বেশি সুদে ঋণ নিলেও এ সুবিধার আওতায় এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের ঋণ নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকেই এ রকম আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরের খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে।
এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ২০১৯ সালে কৃত্রিমভাবে খেলাপির হার কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, করোনা মহামারিতে ব্যাংক খাতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি উত্তরণে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকগুলোর সুশাসন, ঋণ বিতরণ, পর্যবেক্ষণ ও ঋণ আদায়ে গতিবেগের ওপর নির্ভর করছে এ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের সফলতা।