নিয়াজ মাহমুদ: দেশের শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপির তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটির কাছে সুদে-আসলে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ এক হাজার ৮৪ কোটি টাকা। নিয়মিত পরিশোধ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির বিপুল পরিমাণ এ ঋণ এখন খেলাপি। বকেয়া এ ঋণের সুদহার সহনীয় ও ঋণ পরিশোধে মেয়াদ বৃদ্ধিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে আবেদন করেছেন ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন। কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে সুপারিশপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মতামত চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান জাহাজশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনাসহ ওয়েস্টার্ন মেরিনের ঋণ ইস্যু নিয়ে গত ২২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি পাঠায় কোম্পানিটি। অর্থমন্ত্রী গত ২৩ অক্টোবর চিঠিটিতে সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানকে পাঠান। অর্থমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক শিপ বিল্ডার্স; সুতরাং এদের সুযোগ দিতে হবে। আমরা সারা পৃথিবীর জাহাজ নির্মাণ করছি। এ প্রতিবেদনে ওয়েস্টার্ন মেরিন বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার বিষয় তুলে ধরেছে। এসব পরীক্ষা করে পেশ করুন।’
খেলাপি ব্যাংকঋণ প্রসঙ্গে ওয়েস্টার্ন মেরিনের টেকনিক্যাল পরিচালক আরিফুর রহমান খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের তৈরি করা জাহাজের গুণগত মান ভালো হওয়ায় এখন দেশি-বিদেশি শিল্পগ্রুপ আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জাহাজও নির্মাণ করছে ওয়েস্টার্ন মেরিন। জাহাজ নির্মাণের প্রচুর অর্ডার আসছে। কিন্তু অতীতের ব্যাংকঋণের সুদের ঘানি ও বর্তমান ঋণের বোঝায় হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদকে।’ এ শিল্পকে বাঁচাতে স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করতে সরকারের উদ্যোগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেনের চিঠিতে বলা হয়, আট বছরে মোট ৬৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এ শিল্পে মূলধনি বিনিয়োগ করেছি। যার মধ্যে ৭২০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে আমরা পরিশোধ করেছি। তথাপি আমাদের বর্তমান ঋণের স্থিতি রয়েছে (সুদ ও আসলসহ) এক হাজার ৮৪ কোটি টাকা। এ টাকা পর্যাপ্ত সহ-জামানতের বিপরীতে সহনীয় পর্যায়ে সুদের হার নির্ধারণপূর্বক ২০ বছর মেয়াদে যে কোনো সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের সুবিধা প্রদানের আবেদন করছি।
জানা গেছে, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা দেখিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। উচ্চ সুদে বেশি ঋণ নিয়ে বেকায়দায় পড়ে কোম্পানিটির পর্ষদ। জাহাজের প্রধান ক্রেতা ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পর গত দুবছর ধরে সক্ষমতার চেয়ে বিশেষ জাহাজ তৈরির অর্ডারও পাচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এ শিপইয়ার্ডটি। কিন্তু পরিচালকদের মধ্যে বাস্তবভিত্তিক আর্থিক ধারণা না থাকায় শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় কোম্পানিটির নাম উঠে এসেছে বলে জানান কোম্পানি-সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এ কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেড় শতাধিক আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করেছে ওয়েস্টার্ন মেরিন। এর মধ্যে ১২০টি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহƒত হচ্ছে। পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৫টি জাহাজ রফতানি করেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রায় আট কোটি ডলার বা ৬৪০ কোটি টাকা আয় করেছে। এরপরও কোম্পানিটি শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে।
কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যাপক সম্ভাবনা দেখিয়ে ২০১২ সালে একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেয় কোম্পানিটি। এরপরই শুরু হয় জাহাজের প্রধান ক্রেতা ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা। এ সংকট কোম্পানিটির পর্ষদ যথাযথভাবে কাটিয়ে উঠতে না পারায় ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ব্যাংকঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করতে না পারা ও চাহিদানুযায়ী নগদ টাকা না থাকায় ক্যাশ-ফ্লো কমে আসে।
পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিন আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। প্রতিষ্ঠানটি বাজারে সাড়ে চার কোটি শেয়ার বিক্রি করেছে। আইপিওতে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতি শেয়ারের জন্য ৩৫ টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৫ টাকা প্রিমিয়াম। পুঁজিবাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যাংকঋণ পরিশোধ, অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় বাবদ খরচ করা হলেও ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন করায় কাক্সিক্ষত জাহাজ তৈরির অর্ডার পায় কোম্পানিটি। গুণগত মান ঠিক রেখে যথাসময়ে দেশি-বিদেশি জাহাজগুলো ডেলিভারি দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে কোম্পানিটি সক্ষম হলেও উচ্চ সুদে নেওয়া ঋণের ঘানি টানতে হচ্ছে ‘জেড’ ক্যাটাগরির এ কোম্পানিটিকে।