শেয়ার বিজ: চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো আগে থেকে চাপে ছিল। এখন নভেলা করোনাভাইরাস, গত এপ্রিল থেকে এক অঙ্কে সুদ কার্যকর, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন, আবার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি ঘোষণা করা যাবে না সব মিলিয়ে আরও চাপে পড়বে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সোহেল আর কে হুসেইন: গত ১ এপ্রিল সরকার ঋণে ৯ শতাংশ এবং ডিপোজিটে ছয় শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু এর আগে আমাদের নেওয়া ডিপোজিটগুলোর চুক্তি তিন থেকে দুই বছরের ছিল। এগুলো আমাদের দিতে হচ্ছে এবং হবে। ফলে আমাদের সুদ আয় যেভাবে কমেছে, সেইভাবে ডিপোজিট ব্যয় কমেনি। এতে বড় ব্যাংকের মতো আমাদের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোতেও বড় ধরনের লোকসান হয়েছে। তবে বড় ব্যাংকগুলো লোকবল, পজ মেশিন, এটিএম এবং অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, সেক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ অনেক কম। এটা আমাদের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। আর আমরা এখন ডিজিটাল সলিউশনের দিকে যাচ্ছি। যেমন এজেন্ট ব্যাংকিং, ডিজিটাল ফিন্যান্সসিয়াল সার্ভিস, ক্রেডিট কার্ড, ক্ষুদ্রঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী হচ্ছি। এসব খাতে আমাদের ব্যয় অনেক কম হবে। যেমন তখন একটা এটিএম ব্যয় হতো ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত, সেখানে আমাদের বিনিয়োগ পাঁচ লাখ টাকা। এখন বড় ব্যাংকগুলো এ ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ রাখবে, সেখানে আমরা কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারব। অপরদিকে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও আন্তঃব্যাংকিং রেট বেশি ছিল, সেগুলো এখন কমেছে। আগে ১৫ দিন বা ৩০ দিনের আন্তঃব্যাংকিং রেট ছয় ও সাতের মধ্যে ছিল।
গত মঙ্গলবার সেটা এক থেকে দেড় পয়েন্ট কমেছে। এতে বাজারের তারল্য বেড়েছে। তবে এটি সাময়িক সুযোগ। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি ষোষণা করা যাবে না এ সুযোগটাকে আরও বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কারণ কভিডের প্রভাব যেভাবে পড়েছে, তা স্বল্প সময়ে পূরণ করা যাবে না। তাদের সেল ২০১৯ সালের ৫০-৬০ শতাংশ হলেও তারা ব্যাংক সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না।
তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে এ সুযোগের পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এটি এবিবি’র মাধ্যমে কিংবা ব্যাংক খাতের ভালো এক্সপার্ট নিয়ে মূল্যায়ান কমিটির মাধ্যমে হতে পারে, যা গ্রাহকের প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে যৌক্তিক বিবেচনা হতে হবে।
শেয়ার বিজ: করোনা পরিস্থিতিতে অর্থ ও বাণিজ্যের গতি–প্রকৃতি কেমন দেখছেন?
সোহেল আর কে হুসেইন: নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। শুধু তো আমাদের দেশের নয়, পুরো বিশ্বব্যাপী একই অবস্থা। এর মধ্যে কৃষি খাত ভালো করছে, ছোট ছোট এসএমই খাতে কাজ চলছে, বড় বড় উৎপাদন খাতের মধ্যে শুধু নির্মাণ খাতে অনেক স্লো ভাব দেখা যাচ্ছে। অবকাশ, পর্যটন ও এভিয়েশনে মন্দা চলছে। অন্যান্য খাতগুলো ভালো করছে। পাশাপাশি আমাদের রিজার্ভ আগের চেয়ে বেড়েছে। যেহেতু আমাদের এ মুহূর্তে বড় বড় আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হচ্ছে না, আবার দাতা সংস্থার এইড মানি পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটা স্বস্তির খবর। আর ভোগ্যপণ্যের মজুত ভালো আছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে বিলাসী পণ্য বাদ দিয়ে যেন প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকে। এটাতে যেন সংকট না হয়। তবে এটা ঠিক ২০১৯ সালের মতো ব্যবসাসফল বছরে ফিরে যেতে ছয় থেকে ১২ মাস সময় লাগবে, যা স্বল্প সময়ে সহজে রিকভারি হবে না। তবে এর মধ্যে ভালো গ্রাহকরা ব্যাংকের নিয়মিত পাওনা পরিশোধ করছে। এ সুবিধার (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি ঘোষণা করা যাবে না) পর যেন সবাই নিয়মিত পাওনা পরিশোধ করে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় খেলাপি ঋণ বাড়বে। এটাও ব্যাংকের জন্য নতুন করে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে।
শেয়ার বিজ: নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কেমন সতর্কতা অবলম্বন করছেন?
সোহেল আর কে হুসেইন: প্রণোদনা প্যাকেজ এটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করা হবে অনেক কঠিন। প্রণোদনা কিংবা নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কাস্টমারকে মূল্যায়ন করা অনেক কঠিন হবে। সঠিকভাবে যদি মূল্যায়ন করা না হয়, তাহলে নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়বে, যা ব্যাংকের জন্য জন্য সুখকর হবে না। এ জন্য আমরা প্রভিশন বাড়াব। এটা সব ব্যাংক করতে পারে। এ ধরনের কিছু হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে আমরা চাপে পড়ে যাব। এছাড়া সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়ছে। সঙ্গে তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের চাহিদা আছে। সব মিলিয়ে আমাদের আবারও ঋণের সুদ বাড়াতে হবে। যদিও তখন পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুদ কমানো হয়েছিল। আমাদের সুদের হার তো চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করার কথা। আমরা প্রতিযোগিতামূলক ধারা থেকে বের হতে চাচ্ছি। ১৯৯০ সালের দিকে ফিক্সড রেট চালু ছিল। এরপর বেসরকারি ব্যাংক চালু হলো। আর চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক রেটে বেসরকারি খাতে ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। অর্থাৎ গতিশীল অর্থনীতিতে রূপ দিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
শেয়ার বিজ: চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর কস্ট ফান্ড রেট বেশি। বিশেষ করে চলতি বছরের শুরুতে মেঘনা ব্যাংকের কস্ট ফান্ড রেট ছিল ১০ শতাংশের বেশি। আবার বেতন, পদোন্নতি ও প্রমোশনাল ব্যয় প্রভৃতি কমানোর মাধ্যমে মুনাফায় থাকাটাই চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জের। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সোহেল আর কে হুসেইন: এক দিনে ঋণের সুযোগ ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু সেইভাবে তো ডিপোজিট রেট কমেনি। কারণ তিন মাস থেকে তিন বছরের চুক্তি ছিল। এতে আমাদের ব্যাংকিং ট্রেডের ওপর বহুমাত্রিক চাপ তৈরি হয়। তবে আমাদের কস্ট অব ফান্ড কিছুটা কমেছে। অপরদিকে বড় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ, বিজনেস নের্টওয়ার্ক ও সেলস টিম অনেক বড়। তাই তাদের অফিস পরিচালনা, কর্মীদের বেতন কর্তন প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কারণ তাদের বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার বড় চাপ থাকে। এক্ষেত্রে চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংকগুলোকে এ ধরনের চাপ নিতে হচ্ছে না। কারণ বড়দের চেয়ে আমাদের বিনিয়োগ ও ব্যয় দুটোই অনেক কম। আর আমরা ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বাড়ানো এবং ক্রেডিট কার্ড সেবা বাড়ানোয় মনোযোগ দিচ্ছি। এক্ষেত্রে রেগুলার ঋণ এবং মন্দা ঋণ আদায়ে (এনপিএল) মনোযোগী হতে হবে। আর বছর শেষে সব ব্যাংককে প্রভিশন বাড়াতে হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত মুনাফায় থাকা অনেক চ্যালেঞ্জের হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সুদের হার বাড়াতে হবে। বিদ্যামান সুদ আয় দিয়ে ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা অনেক কঠিন হবে। আর ব্যাংকের যদি মুনাফা কমে যায়, কিংবা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেনে আমরা চাপে পড়ে যাব। এমনিতে আমাদের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা আছে। এটা কাটানো সম্ভব হবে, যদি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে রেগুলেটরিং সাপোর্ট ও পলিসি সাপোর্ট দেয়। এটা নিয়ে এখন থেকে ভাবনা শুরু করতে হবে। আর খেলাপি ঋণ যাতে না বাড়ে, সেজন্য পরিকল্পনার কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। তা না হলে এনপিএল ব্যাংকের পরিচালনায় বড় ধরনের হিট করবে।
শেয়ার বিজ: কিন্তু মেঘনা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন তো আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ইসা বাদশার মালিকানাধীন ইসা অ্যান্ড মুসা ব্রাদার্স তো অন্যান্য ব্যাংকে খেলাপি। মেঘনা ব্যাংকেও ৬০ কোটি টাকা ঋণ আছে। তার তো খেলাপি হওয়া সুযোগ অনেক বেশি।
সোহেল আর কে হুসেইন: তিনি তো দেশের নেই। এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমরা এরই মধ্যে কিছু প্রভিশন রেখেছি। আমরা তার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এক্ষেত্রে নিশ্চয় বাংলাদেশ ব্যাংকও খোঁজখবর রাখছে। তাকে কিছু করতে হলে অবশ্যই দেশে আসতে হবে। রিকভারির জন্য সব ব্যাংক মিলে একটা কম্প্রোমাইজ প্যাকেজ দিতে চেষ্টা করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে তো ছাড় দিতে হয়। আর প্রয়োজনে আমরা কানাডায় যোগাযোগ করব। শুধু তিনি নন, সব পলাতক খেলাপি ঋণের গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর উচিত হবে পলাতক গ্রাহকদের খুঁজে বের করা। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ধরে আনতে হবে।
শেয়ার বিজ : মেঘনা কবে পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে?
সোহেল আর কে হুসেইন: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হলে ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে। আমাদের পরিশোধিত মূলধন ৪৮০ কোটি টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ আমাদের ৫০০ কোটি টাকার চেয়ে কিছু কম আছে, যা আমরা দ্রুত সময়ে পূরণ করব। নির্দিষ্ট তারিখ তো বলা যাবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য, ক্যাপিটাল প্ল্যান নিয়ে কাজ করছি। পুঁজিবাজার কিন্তু এখন বিনিয়োগের সবচেয়ে ভালো ও উপযোগী সময়। কেউ যদি দীর্ঘসময় নিয়ে বিনিয়োগ করেন, তাহলে অনেক ভালো ক্যাপিটাল গেইন পাবেন। সঙ্গে তো নিয়মিত মুনাফা আছে। আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটের দিকে আরও মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে মূলভিত্তিক শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে।
শেয়ার বিজ : আপনাকে ধন্যবাদ।
সোহেল আর কে হুসেইন: আপনাকেও ধন্যবাদ।