Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:32 am

ঋণের সুদ পরিশোধ নিয়ে বিপদের মুখে বাংলাদেশ!

বিশেষ প্রতিনিধি: কয়েক বছর ধরে সরকারের ঋণ দ্রুত বাড়ছে। বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বিশেষ করে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া অনেক বাড়িয়েছে সরকার। তবে সে ঋণ পরিশোধ নিয়ে চাপও বাড়ছে সরকারের ওপর। বিশেষত ঋণের সুদ পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বাড়ছে সুদের হারও। এতে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি ২০২৩-২৪ হতে ২০২৫-২৬’ পর্যালোচনা করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। নীতি বিবৃতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী কয়েক বছরের জন্য সুদ পরিশোধের পরিমাণ ও সুদ হারের প্রক্ষেপণ তুলে ধরেছে। এতে দেখা যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারের সুদ পরিশোধ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণের সুদহারও এ সময়ে দ্বিগুণ হবে।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতির তথ্যমতে, গত অর্থবছর বাংলাদেশ সরকারকে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ছিল চার হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর বাজেটের মোট ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছর সরকারের ঋণের অন্তর্নিহিত সুদহার ছিল পৌনে ৬ শতাংশের মতো। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদহার ছিল আট শতাংশের কিছু বেশি ও বৈদেশিক ঋণের সুদহার ছিল এক শতাংশের মতো।

চলতি অর্থবছর সংশোধিত হিসাবে সরকারের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হচ্ছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ২৭ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি অর্থবছর সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৮০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ছিল ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২১ দশমিক ৭২ শতাংশ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১০২ দশমিক ১৭ শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছর সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদহার কিছুটা কমে আট শতাংশের নিচে নেমেছে। আর বৈদেশিক ঋণের সুদহার কিছুটা বেড়ে এক শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে সরকারের ঋণের অন্তর্নিহিত সুদহার মোটামুটি অপরিবর্তিতই ছিল। যদিও আগামী অর্থবছর তা কিছুটা বাড়বে বলেই প্রাক্কলন করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, আগামী অর্থবছর সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় খুব বেশি বাড়বে না। তবে ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছর তা দ্রুত বাড়বে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতির তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৯৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৮২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় দেড় শতাংশের মতো বাড়লেও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ বাড়বে।

এদিকে আগামী অর্থবছর সার্বিকভাবে সরকারের ঋণের অন্তর্নিহিত সুদহার ছয় শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদহার আট শতাংশে পৌঁছালেও বৈদেশিক ঋণের সুদহার দুই শতাংশে ঠেকবে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের পরিমাণই দাঁড়াবে এক লাখ ৮০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়বে এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাড়বে ১৫ শতাংশের কিছু বেশি। সার্বিকভাবে ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধ বাড়বে প্রায় ২২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও ২০২৪-২৫ অর্থবছর সার্বিকভাবে সরকারের ঋণের অন্তর্নিহিত সুদহার কিছুটা কমবে।

অন্যদিকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের পরিমাণই দাঁড়াবে এক লাখ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ দাঁড়াবে ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় প্রায় ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ বাড়বে এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাড়বে প্রায় ২২ শতাংশ। সার্বিকভাবে ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধ বাড়বে প্রায় ১৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

২০২৫-২৬ অর্থবছর সরকারের ঋণের অন্তর্নিহিত সুদহার সার্বিকভাবে কিছুটা বাড়তে পারে। ওই অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদহার দুই শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদহার কিছুটা বাড়বে। সার্বিকভাবে পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ বাড়বে প্রায় ৮২ শতাংশ ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বাড়বে প্রায় ৩০০ শতাংশ। এছাড়া এ সময় বিদেশি ঋণের সুদহার দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মূলত তিনটি কারণে এ সুদের পরিমাণ বাড়ছে। প্রথমত, আগে যেসব ঋণ নেয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশ কয়েকটি বর্তমানে পরিপক্ব (ম্যাচিউর) পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে এগুলো এখন পরিশোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঋণ আসছে, সেগুলোর রেয়াতকাল ও পরিশোধের সময়সীমা আগের ঋণের তুলনায় কম। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বড় ঋণ নেয়া হয়েছে, যেগুলো সাশ্রয়ী নয়। এগুলোর মধ্যে অনেক কঠিন শর্তের ঋণ রয়েছে এবং সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট রয়েছে।’

এ ঋণ কী ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারেÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঋণের অর্থ মূলত অবকাঠামো খাতে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু যেসব অবকাঠামোয় এ ঋণ কাজে লাগানো হয়েছে, সেগুলো থেকে এখনও কোনো রিটার্ন আসা শুরু হয়নি। ফলে ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ছে।’

ড. দেবপ্রিয় উল্লেখ করেন, ‘বাজেটে মূলত তিনটি খাতে ব্যয় দ্রুত বাড়ছে এবং এগুলোই এখন সরকারের ব্যয়ের বড় খাত। এগুলো হচ্ছে জনপ্রশাসনের ব্যয় (কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আনুতোষিক), ভর্তুকি এবং সুদব্যয়। এসব ব্যয় যদি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো কার্যক্রমে ব্যয়ের সক্ষমতা আরও কমে যাবে, যা এক ধরনের ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’

উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর এ ব্যয় ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৫৭ হাজার ৪০০ কোটি ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ হাজার ৬০০ কোটি টাকায়। এ হিসাবে ১০ বছরে সুদ পরিশোধ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় চারগুণ।