শেখ আবু তালেব: কভিড-১৯ দ্বিতীয় আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। সংক্রমণের প্রকোপ কমাতে বিরতি দিয়ে লকডাউন ঘোষণা করছে সরকার। এতে শিল্প উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। থমকে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা। উদ্যোক্তারা ভুগছেন তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায়। এজন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সকরারের কাছে নগদ অর্থের প্রণোদনা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রণোদনা চেয়ে এরই মধ্যে একাধিক মন্ত্রী, সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এছাড়া সরকারদলীয় সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে চলছে তাদের মতবিনিময়। উচ্চ পর্যয়ের এসব বৈঠকে অংশ নেয়ার পরে ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যেও আলাপ-আলোচনা করছে। তৈরি করছে বিভিন্ন প্রস্তাবনা। সরাসরি উপস্থিতির পাশাপাশি করোনাকালে বৈঠকগুলো চলছে অনলাইন মাধ্যমেও।
এসব বৈঠকে উপস্থিত থাকছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বিকেএমইএ, বিটিএমইএ ও তৈরি পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। অর্থ মন্ত্রণালয় ও একাধিক ব্যবসায়িক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
দাবির পক্ষে সম্প্রতি একটি আনুষ্ঠানিক চিঠিও দিয়েছে এফবিসিসিআই ও ডিসিসিআই। এতে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখন চলছে। সরকারও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক লকডাউন দিচ্ছে। কখনও কখনও উৎপাদন কার্যক্রম পুরোটাই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কিন্তু ভবন ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল মাস শেষে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যথাসময়ে পণ্য বাজারে যেতে পারছে না।
অন্যদিকে করোনাকালে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কারখানা পরিচালনায়। বর্তমানে ব্যাংকঋণ পরিশোধে কিছুটা সময় দেয়া হয়েছে মাত্র। কিন্তু জমে থাকা ঋণের কিস্তি তো পরিশোধ করতে হবে। এভাবে ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তারা দাবি করেছেন, করোনার প্রকোপ বিশ্ব থেকে সহসাই যাচ্ছে না। প্রথম ঢেউ সামাল দিয়ে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটা শুরু করা সম্ভব হয়েছিল। রপ্তানিও বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু ফের হোঁচট খেতে হলো। বাংলাদেশে এখন দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। অনেক দেশেই তৃতীয় ঢেউ শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশেও তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে, এমন শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাহেলে কীভাবে চলবে উৎপাদন কার্যক্রম। এতে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে।
এজন্য সাময়িক প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালানো যাবে না। অর্থনীতির ৮০ শতাংশই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা পরিচালনা করেন। উদ্যোক্তারা এখন ব্যবসা পরিচালনা তো দূরের কথা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এজন্য উদ্যোক্তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে। দিতে হবে আর্থিক ক্ষতির প্রণোদনা, যাতে তারা ব্যবসা পরিচালনায় সমস্যায় না পড়েন। এটি না করতে পারলে অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যবে।
বেকার হয়ে পড়বেন অনেক মানুষ। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ হবে না। এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিধিনিষেধ দিয়ে সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হচ্ছে। যদি করোনার প্রতিষেধক টিকা দেয়ার সংখ্যা বাড়ানো যেত, তাহলে হয়তো এত কঠোর সিদ্ধান্ত ঘনঘন নিতে হতো না সরকারকে। অনেক সময়ে আমরা সিদ্ধান্তের কথা আগে থেকে জানতেই পারি না। এমন অনিশ্চয়তায় কীভাবে কারখানা পরিচালনা করা সম্ভব? এজন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে চলেছি, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে হলে আর্থিক সক্ষমতা ঠিক রাখতে হবে। সরকার জীবন বাঁচানোর জন্য লকডাউন দিয়েছে। আমরাও চাই জীবন আগে বাঁচুক। জীবন না থাকলে অর্থ দিয়ে কী হবে? আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে কাদের দিয়ে অর্থনীতি পরিচালনা করা হবে। সেই জনবল তো পাওয়া যাবে না। এজন্য আমরাও বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষেই রয়েছি। শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে।
এখন উদ্যোক্তাদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আপাতত কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষকে তো কাজে ফেরার সুযোগ দিতে হবে। উদ্যোক্তারা টিকে থাকতে পারলেই এটি সম্ভব। এজন্য শুধু ঋণ প্রণোদনা দিয়ে এটি হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য প্রণোদনা দিতে হবে।
এদিকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের জন্য এখন শীতকালীন পোশাক তৈরি করছে বাংলাদেশের কর্মীরা। কিন্তু বিধিনিষেধের কারণে কারখানা বন্ধ রয়েছে। এতে যথা সময়ে পণ্য রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আমরা চাই তৈরি পোশাককর্মীদের দ্রুত টিকা দিয়ে কাজে ফিরিয়ে আনতে। যতদিন না তাদের কাজে নিয়মিত করা যাচ্ছে, ততদিন এ খাতকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। খাতটি তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। এখন একে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন বড় উদ্যোগ।
এ বিষয়ে ডিসিসিআই প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জীবন বাঁচিয়ে জীবিকার পথ খোলা রাখতে হবে। আমরা সরকারের অতীতে নেয়া সিদ্ধান্তের সুফল পেয়েছি। করোনার প্রথম আঘাতের পরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছিল মাত্র। কিন্তু আবার হোঁচট খেল। এত বড় অর্থনৈতিক ধাক্কার অভিজ্ঞতা আমাদের কারও নেই। প্রয়োজন মেটাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পণ্য দিতে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়তে দেয়া যাবে না। এজন্য ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরছেন বিভিন্ন ফোরামে।’
প্রসঙ্গত, করোনার প্রথম ঢেউ আঘাত হানার পরে এক লাখ আট হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। পরে খাতভিত্তিক কয়েকটির বরাদ্দ বাড়িয়ে তা এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ব্যাংকগুলো এখনও তা বাস্তবায়ন করে চলেছে। শুধু বড় শিল্পগ্রুপ ও তৈরি পোশাক খাত ছাড়া আর কোনো খাতেই শতভগ ঋণ বিতরণ হয়নি এখনও।