নিজস্ব প্রতিবেদক: ঋণ পরিশোধের জন্য সরকার নতুন করে ঋণ নিচ্ছে বলে দাবি করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের ঋণ ও পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে, যা সরকারকে অপর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য ক্রমাগত নতুন ঋণ নিতে বাধ্য করছে। কভিড বা ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, ভিন্ন কারণে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা ত্বরান্বিত হয়েছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল আয়োজিত ‘বাংলাদেশের সরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ এবং পরিশোধের সক্ষমতা: উদ্বেগের কারণ আছে কী?’ শীর্ষক সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়। সিপিডি ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ পরিশোধের জন্য ঋণ নিচ্ছি। তাই দ্রুত অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের যে রাজস্ব ব্যয়ের হিসাব রয়েছে, সেখানে বৈদেশিক ঋণের কেবল সুদ পরিশোধের ব্যয় প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু আসল পরিশোধের হিসাব প্রদর্শন করা হয় না। এটি প্রদর্শন করা হলে রাজস্ব বাজেটে ঘাটতি দেখা যাবে। এক্ষেত্রে হিসাব প্রদর্শনে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বেড়েছে। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা তুলনামূলকভাবে বেশি নয়। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে সিপিডি জানিয়েছে, ঋণ পোর্টফোলিওর গঠন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, অন্যদিকে রেয়াতি ও বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্তাবলিও আরও কঠোর হচ্ছে। বিশেষত জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতার দ্রুত বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর।
অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন তোলেন যে, সরকার বিদেশি ঋণে একের পর এক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না কেন। তার মতে, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বৈদেশিক ঋণের মেগাপ্রকল্পকে পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে, এমনকি বিদেশে অর্থও পাচার করছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা রাজস্ব সংগ্রহ করে উন্নয়ন প্রকল্পে একটি টাকাও দিতে পারছি না। বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা প্রতারণামূলক বাস্তবতার মধ্যে আছি। ঋণ নিয়ে এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই। এত কিছু করলাম, কিন্তু মানুষ সুবিধা পেল না কেন?’
প্রতারণামূলক বাস্তবতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এত মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এখনও ২৩ শতাংশে কেন আটকে আছে? সরকারি হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন অনুসারে, মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যুহার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। গত দেড় দশকে এত কিছু করলাম, তাহলে মানুষ এসবের সুফল পেল না কেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘উল্টো আমরা কী দেখলাম, ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটতরাজ হয়েছে। বৈদেশিক ঋণের মেগাপ্রকল্পকে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তা বেশি হয়েছে। আমার বিশ্বাস মেগা প্রকল্পের সঙ্গে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টাকা পাচারের সংশ্লেষ পাওয়া যাবে।’
অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাসহ আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। কীভাবে আমরা ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করব, কীভাবে আমরা রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াব, তা নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত। কারণ রপ্তানি বাড়লে তা ঋণ পরিশোধকে সহজ করবে। এখন রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা দরকার।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একজন বিশেষ উপদেষ্টা আছে, যার একটি শক্তিশালী ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। তাকে দুর্নীতি এবং বিশেষ সুবিধাভোগীদের মোকাবিলা করতে হবে। সিপিডির চেয়ারম্যানের মতে, ঋণ করে প্রকল্প করলে ২০-৫০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়।