সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: এক সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তিতে প্রাধান্য ছিল। কারণ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা দেশের শিল্প-বাণিজ্য খাতে নেতৃত্ব প্রদান করত। কিন্তু ব্যবসায়িক অদক্ষতা, বৈচিত্র্যের অভাব, পরিচালনাগত ব্যর্থতায় এবং ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে দেশের শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে মন্দ ঋণগুলো নিয়মিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু নতুন করে ঋণপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, পুরোনা ব্যবসায় ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় চট্টগ্রামের অধিকাংশ খেলাপি ব্যবসায়ী ঋণ পুনর্গঠনে আগ্রহী হচ্ছেন না। উল্টো নানা অজুহাতে সময় পার করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এ নীতিমালায় স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দ মানের ঋণখেলাপিরা বিশেষ এ সুবিধা ঘোষণা দেওয়া হয়। অর্থাৎ সব খেলাপির জন্যই বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। পুনঃতফসিলের পর ঋণখেলাপিরা নিতে পারবেন নতুন ঋণও।
নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সুবিধা পাবেন। কেস টু কেস বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে এক বছরের জন্য গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যাবে। অর্থাৎ প্রথম এক বছরে খেলাপিদের ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। মওকুফ হবে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ ও ইন্টারেস্ট সাসপেন্সেস হিসেবে রক্ষিত সুদও। তবে জারিকৃত নীতিমালায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন ট্রেডিং (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজ শিল্প, লোহা ও ইস্পাত শিল্প খাতের ঋণখেলাপিরা। এসব খাতের খেলাপি গ্রাহকরা সরাসরি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। অন্য খাতের ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিল সুবিধা পেতে ব্যাংকের বিশেষ নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। আর এ সুযোগের আওতায় ৫২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন মাস অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়েই পুনঃতফসিল করা হয় ২১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এসব কারণে আদায় না বাড়লেও গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কমে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা হয়।
ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যায়, এমইবি গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, বাদশা গ্রুপ, লিজেন্ড গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপ, মাবিয়া গ্রুপ, সিলভিয়া গ্রুপ, বাগদাদ গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপ, হালদা গ্রুপ, সিদ্দিক গ্রুপ, এমএইচ গ্রুপ, সানোয়ারা গ্রুপ, আম্বিয়া গ্রুপ, জিকে গ্রুপ, গোল্ডেন হরাইজন, আম্বিয়া স্টিল রি-রোলিং মিলস, জেসি ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড, তানিয়া এন্টারপ্রাইজ, জাহিদ এন্টারপ্রাইজ, শীতল এন্টারপ্রাইজ, পেনিনসুলা স্টিল, ফরচুন স্টিল, শফিক স্টিল, সুপার সিক্স স্টিল, শাহেদ শিপ ব্রেকিং লিমিটেড, ম্যাস শিপ ব্রেকিং, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, এনবিআর স্টিল, এস স্টিল, সুলতানা শিপ ব্রেকিং লিমিটেড, শাহ আমানত আয়রন, এসকে স্টিল লিমিটেড ইত্যাদিসহ আরও শতাধিক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি খেলাপি পাওনা আছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক বন্ধ আছে। অন্যদিকে কয়েকটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণ করে মোস্তফা গ্রুপ ও নূরজাহান গ্রুপ।
এ বিষয়ে নূরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থপনা পরিচালক জাহিদ উদ্দিন আহম্মেদ রতন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি কয়েকটি লিজিং ও ব্যাংকে ঋণ রি-শিডিউল করেছি। কিন্তু নতুন করে ব্যবসা পরিচলনার জন্য ঋণ না পাওয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্তত ২০০ কোটি টাকা হলে আমি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম। আমাকে ব্যবসা করার সুযোগ দিলে অবশ্যই ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করব।’
চট্টগ্রাম বিভাগের কর্মরত একাধিক ব্যাংকের দায়িত্বশীল ব্যাংকাররা বলেন, গত বছর জুনে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ খেলাপি ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসেনি। অথচ এগিয়ে এলে তারাও লাভবান হতো। আমরাও লাভবান হতাম। পাশাপাশি চট্টগ্রাম নিয়ে যে ব্যাংকগুলো নেতিবাচক ধারণা ছিল, সেটাও পরিবর্তন হতো। এর মধ্যে কিছু খেলাপি গ্রাহক আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি দিলেও প্রয়োজনীয় অর্থ জমা করেনি। আবার কিছু গ্রাহক দেশে নেই। আর পাওনা আদায়ে আমরাও অর্থঋণ আদালতে মামলা করছি। এ মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে আছে। ফলে টাকাও আটকে আছে। আসামির বিচার হচ্ছে না। তার পাওনা পরিশোধে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ দেশের ভাবমূর্তির জন্য এসব খেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল এবং দরকার আছে। তা না হলে খেলাপি পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সানোয়ারা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের চট্টগ্রাম থেকে ব্যাংক সবচেয়ে বেশি মুনাফা আয় করত। যখন আমাদের অবস্থা একটু খারাপ হতে লাগল, তখন ব্যাংকগুলো অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এতে আমাদের চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো অবস্থা খারাপ হতে থাকে। অথচ একই গ্রুপ একটি বা দুই প্রতিষ্ঠান খারাপ হয়েছিল। কিন্তু আরও আট বা অধিক কোম্পানি তো ভালো ছিল। সেইগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এছাড়া ২২-২৫ শতাংশ সুদ ছিল। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এখন ব্যাংকগুলো উচিত যতটুকু সম্ভব সুদ না নিয়ে আসলটা পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করা। শুধু মামলা করলে হবে না। একজন গ্রাহককে ঘুরে দাড়াঁনোর জন্য সহযোগিতা করতে হবে।’
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ বেলাল বলেন, ‘চট্টগ্রামের বড় বড় ও শীর্ষ ঋণখেলাপিরা রি-শিডিউলের জন্য আবেদন করেনি। যদিও গত অক্টোবরের আবেদনের শেষ সময় ছিল। এর মধ্যে কিছু আবেদন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আর কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। বড় গ্রাহকের মধ্যে এসএ গ্রুপ ও নুরজাহান গ্রুপ নিয়মিত করেছে ঋণ। কিন্তু মোস্তফা গ্রুপ এখনও পর্যন্ত করেনি। যদিও তাদের এমডি দেশে নেই। এছাড়া বলাকা গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপসহ জাহাজ ভাঙা ও ভোগ্যপণ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদনই করেনি। অথচ তাদের জন্য এ সুযোগ ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।’