ঋণ প্রদানে সতর্কতারও বিকল্প নেই

অর্থঋণ আদালতে গত দুই বছর বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা মামলার পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যায়, খেলাপি ঋণ কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে চট্টগ্রামে। গতকালের শেয়ার বিজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১৭টি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা, তাদের মধ্যে রয়েছেন মুদি দোকানি থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ী। আইনি পদক্ষেপ গৃহীত হলেও খেলাপিদের থেকে পাওনা আদায়ের ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অনেক ব্যবস্থাপক। বস্তুত হিসাব করলে দেখা যায়, ২০১৫-২০১৬ সালে প্রতি মাসে অর্থঋণ আদালতে গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় ৭০টি। সে অনুযায়ী জানুয়ারিতে মামলা কম হলেও পাওনা আদায়ের ব্যাপারে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, সেটা উদ্বেগের।

ব্যাংক, ট্রেড ইউনিয়ন ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদক জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক অদক্ষতা, টানা লোকসান, ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের ধারাবাহিক দরপতনের কারণেই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এমন পরিস্থিতি। সন্দেহ নেই, লাভের মতো লোকসানও ব্যবসার অংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ওঠানামাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু ব্যবসায়িক অদক্ষতায় কোনো গ্রাহক যদি খেলাপি হয়ে পড়েন, তার কিছুটা দায় কি ব্যাংকের ওপরও বর্তায় না? কারও অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা যাচাই না করে ব্যাংক তার হাতে মানুষের সঞ্চিত অর্থ তুলে দেবে কেন? ঋণের অনুমোদনকৃত অর্থের বিপরীতে উপযুক্ত সহযোগী জামানতও থাকার কথা। এখন কোনো ব্যবসায়ী যদি ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থ হন, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, তাদের ঋণ অনুমোদনে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছিল কি? বন্ধককৃত সম্পত্তির মূল্যায়ন কি হয়েছিল সঠিকভাবে? এসব প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত ছিলেন, তারা কতটা স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার অনুসরণ করেছেন, প্রশ্ন উঠবে সে ব্যাপারেও। আমরা চাইবো, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পাশাপাশি উল্লিখিত বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখবেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি শেয়ার বিজের কাছে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তার বক্তব্য, ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগও দিতে হবে। এটা ঠিক, লোকসান কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যবসায়ীদের কিছুটা সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদেরও বিবেচনায় রাখতে হবে, ঋণ হিসেবে দেওয়া অর্থ আদায়ে ব্যাংক অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে না। খেলাপি ঋণের বিপরীতে মুনাফা থেকে সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এর চাপ আবার গিয়ে পড়ে আমানতকারীর মুনাফা ও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশে। ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগের কথা বলে তারা যদি সময় নিতে থাকেন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়ায়ই সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা।

ব্যাংকিং বিজনেস পরিচালিত হয় আমানতকারীর কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে ব্যাংকও ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল। তাই আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যবসায়ীদের বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে ব্যাংককে। এক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিকে কাজে লাগানো যায় কি না, সেটিও আমরা ভেবে দেখতে বলবো। কেননা বেশি মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে স্থানীয়দের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে ব্যাংকের পারফরম্যান্সে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেউ যদি ব্যাংকের দায় পরিশোধ থেকে বিরত থাকেন, সেক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতাও চাওয়া যেতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে একটি প্রবচন আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। ব্যাংকঋণ প্রদানে সঠিক গ্রাহক নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন ব্যবসায় ঋণ দেওয়া হবে, কোন ব্যবসায়ীকে দেওয়া হবে এবং কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হবে না, এসব ব্যাপারে ভাবতে হবে ঋণ অনুমোদন ও অর্থ ছাড়ের আগেই। চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলো যদি এ ধারা অনুসরণ করতো, তাহলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বলে মনে হয় না।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০