নিজস্ব প্রতিবেদক: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নিরাপদ, বিশ্বস্ত এবং নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) এবং এসপায়ার টু ইনোভেট-এটুআইয়ের সহযোগিতায় একটি মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। গতকাল ঢাকার আইসিটি টাওয়ারের বিসিসি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী, শিক্ষাবিদ, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন তাদের মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে কাজ করছে। ইউনেস্কো এবং ইউএনডিপিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার এআই-সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি, নীতি কাঠামোর উন্নয়ন ও তার প্রসার, এবং এর নিরাপদ-বিশ্বস্ত-নৈতিক ব্যবহার সম্পর্ক অবগতির জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি ও উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটুআই বিভিন্ন খাতে নীতিনির্ধারণ এবং এআই-সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে।
উদ্বোধনী অধিবেশনে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক এআই প্রযুক্তির রূপান্তরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয় তুলে ধরেন। তিনি প্রযুক্তিগত সমাধান, সময়োপযোগী নীতি কাঠামো, নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এআই প্রযুক্তি যেন আমাদের সমাজে প্রযুক্তি বৈষম্য বৃদ্ধি না করে বরং এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনার পাশাপাশি সমাজের সবার ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে।’
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে আইসিটি বিভাগের সচিব মো. শামসুল আরেফিন বলেন, ‘আমরা সবার সুবিধার জন্য নৈতিক এআইয়ের রূপান্তরকারী শক্তিকে কাজে লাগাতে চাই। আমরা চাই এমন একটি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে, যেখানে এআই প্রযুক্তি আমাদের সমাজে নৈতিকভাবে অবদান রেখে একটি টেকসই স্মার্ট সমাজ কাঠামো গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসেন খান বলেন, ‘এআইয়ের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে আমাদের করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কার্যকর ও টেকসই কর্মকৌশল প্রণয়নে এআই অভিযোজনের সমস্যা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।’
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ ভূঞা তার বক্তব্যে এআই নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০১৮ সাল থেকে এআই নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, এর ফলে ২০১৯ সালে ‘এআই ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ২০১৯’ তৈরি হয়। এখন আমরা এআই নীতিমালা এবং এআই আইনে নৈতিকতার বিষয়টি সংযুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছি।’
বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদলের প্রধান চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউনেস্কোর এআই র্যাডিনেস অ্যাসেসমেন্ট মেথডলজির মতো উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করে। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি এআই প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে আইন, সামাজিক সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত বিবেচনা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।’
ঢাকায় ইউনেস্কো অফিসের প্রধান হুহুয়া ফ্যান ওআইসি বলেন, ‘আমাদের এ সংলাপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের একত্র করা হয়েছে। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে র্যাম কান্ট্রি রিপোর্ট ও এর নীতিগত সুপারিশ তৈরি করার সুযোগ তৈরি করবে বলে আশা করছি।’
ইউএনডিপি বাংলাদেশের ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি সোনালী দয়ারত্নে বলেন, ‘সব দেশই এআই দ্বারা প্রভাবিত এবং উদীয়মান অর্থনীতির বৈশ্বিক এআই রেসে একটি কণ্ঠস্বর প্রয়োজন। সেই আওয়াজ দিয়ে আমরা বাংলাদেশের ক্ষমতায়ন করতে চাই।’
ইউনেস্কোর সামাজিক ও মানব বিজ্ঞানের সহকারী মহাপরিচালক গ্যাব্রিয়েলা রামোস বলেন, ‘ইউনেস্কোয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত কথোপকথনকে কেবল একটি প্রযুক্তিগত হিসেবে না দেখে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। এই প্রযুক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কোনো উদ্দেশ্য নয় বরং এর যথাযথ পরিচালনার মাধ্যমে মানুষের লক্ষ্য পূরণ করে সামগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করাই মূল লক্ষ্য।’
মতবিনিময় সভায় শিক্ষা, পরিবহন, গার্মেন্টস, কৃষি এবং বাণিজ্যসহ সব খাতে এআই কৌশল, নীতি প্রণয়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। এসব খাতে সুনির্দিষ্টি এআই কৌশল মানা না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। একই সঙ্গে কৌশল ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এআই নীতি কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজনীতার বিষয় উল্লেখ করেন বক্তারা। প্যানেল আলোচনা এবং ব্রেকআউট গ্রুপ সেশনের মাধ্যমে নিরাপদ এবং বিশ্বস্ত এআই সম্পর্কিত ধারণা, এর নৈতিক ব্যবহার এবং এআই প্রযুক্তির সামাজিক প্রভাবের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে এআই টেকনোলজির গ্লোবাল গভর্ন্যান্সের ওপর একটি প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ইউনেস্কো সদর দপ্তরের সেকশন ফর বায়োইথিকস অ্যান্ড দ্য এথিক্স অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট জেমস রাইট এবং ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের এডুকেশন প্রোগ্রাম সেক্টরের প্রধান হুহুয়া ফ্যান। আলোচনাটি পরিচালনা করেন ইউএনডিপির সিনিয়র গভর্ন্যান্স স্পেশালিস্ট শীলা হক।