Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 10:02 am

এআই ব্যবহারের আদ্যোপান্ত

জেনারেটিভ এআই (অও) এখনকার বাজার দখল করতে শুরু করেছে। এখন বড় বড় কোম্পানিগুলো তো আছেই, শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত এআই’র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা শুরু করেছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ এবং হার্ভার্ডের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যাট জিপিটি (ঈযধঃচেঞ) এখন যেই অবস্থায় আছে সেটার কারণেই বর্তমান মার্কেটারদের কর্মকাণ্ড ৪০% উন্নতি করেছে। তাহলে এটা কল্পনা করাই যায় যে, আর দুয়েক বছর পর এই এআই আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে।

এমনিতেও গত ১৫ বছরে মার্কেটিং জগতে ডিজিটাল মার্কেটিং, মার্কেটিং টেকনোলজির মতো বেশ কিছু নতুন ধারণার আবির্ভাব ঘটেছে। বোঝাই যাচ্ছে টিকে থাকতে গেলে আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই হবে। টেকনোলজির যত উন্নতি হবে কনটেন্টের সংখ্যাও তত বাড়বে, বাড়বে নতুন নতুন আইডিয়ার মাত্রাও। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই লক্ষ্য করা যায়।

ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, পারসোনালাইজড কনটেন্টের পরিমাণ বাড়বে। যার ফলে, ব্যক্তির স্বতন্ত্র পছন্দ-অপছন্দ, বয়স, লিঙ্গ অনুযায়ী কনটেন্ট তাকে সরবরাহ করা হবে। ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে তার ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাবে, তার কোনো ব্র্যান্ড ভালো লাগে, কোনো ফুটবল টিমকে সে পছন্দ করে ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তাকে কনটেন্ট সরবরাহ করা হবে।

আবার নেতিবাচক একটি দিক হলো, কনটেন্ট ওভারলোড। এর কিছুটা অভিজ্ঞতা আমাদের এখনই হচ্ছে। একই রকম দেখতে অনেকগুলো কনটেন্ট বারবার আমাদের চোখের সামনে পড়ার কারণে যে কেউই প্রচণ্ড বিব্রতবোধ করতে থাকে। করাটাও স্বাভাবিক। কেননা যেহেতু এআই যেকোনো বিষয়ে খুবই সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে তাই। এআই’র ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা কনটেন্টগুলোতেও অনেকটা একই উপাদান থাকে। যার ফলে কনটেন্টের সংখ্যা ঠিকই বাড়ছে। তবে সেগুলোই অধিকাংশই শুনতে একইরকম লাগে।

এই সমস্যার সমাধানও কিন্তু আমাদের কাছে আছে। এর জন্য প্রধানত আমাদের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে হবে। অর্থাৎ এমন একটি জনশক্তি তৈরি করতে হবে, যারা যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এআই টুলস তৈরি করতে পারবে, ব্যবহার করতে পারবে এবং পরিব্যাপ্ত করতে পারবে। অর্থাৎ তারা কেবল প্রযুক্তির গতানুগতিক ব্যবহারই নয় সৃজনশীল উপায়ে তা কাজেও লাগাতে পারবে। যেকোনো পণ্য বা সেবা মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে এআই এর ব্যবহার এখন বাধ্যতামূলক। কিন্তু শুধু এটার ওপর নির্ভর করে থাকলেই কি কোম্পানিগুলো এগিয়ে যাবে? মোটেও না। এর জন্য অবশ্যই এমন একদল লোক থাকা আবশ্যক যারা ভোক্তাদের চাহিদা বুঝবে, সে অনুযায়ী নিজেদের পণ্য বা সেবাকে কাস্টমাইজড করতে পারবে। অর্থাৎ মৌলিকত্ব থাকবে তাদের কাজে, সেই মৌলিকত্বের ওপর ভিত্তি করে তারা এআই’র ব্যবহার করবে।

যেকোনো শিল্পের জন্যই এই কথা সত্য। যেমন: যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বর্তমান সময়ের তরুণদের নিয়ে কাজ করে থাকে তাহলে সময় পার হতে হতেই তাকে পরবর্তী তরুণদের ধরেই এগোতে হবে। নয়তো তার প্রতিষ্ঠান এখন যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকবে।

আমরা হয়তো ভাবছি যে, এআই আসার কারণে আমাদের কাজের চাপ হয়তো কমে যাবে, হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাব, নিজেদের এবং পরিবারের জন্য আরও বেশি সময় বের করা যাবে। কিন্তু আদৌ কি এরকম কিছু ঘটা সম্ভব? ভেবে দেখুন তো গত কয়েক দশক আগেও যখন কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটারসহ নতুন নতুন কিছু প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে তখন সবাই একইরকম খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল এখন আর কষ্ট করে সব ডকুমেন্ট হাতে লিখতে হবে না, প্রেজেন্টেশন নিজ হাতে তৈরি করতে হবে না। যেকোনো হিসাবের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যালকুলেটর নিয়ে টেপাটেপি করতে হবে না। কিন্তু এত বছর পরে এসেও কি আমাদের কাজের চাপ কমেছে, কর্মঘণ্টা কমেছে? কমেনি। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেড়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম নামে। কাজ করা হয়তো কিছুটা সহজ হয়েছে কিন্তু কাজের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে আরও অনেকগুণ।

এছাড়া, এআই ব্যবহারের আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ এবং হার্ভার্ডের করা সেই গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, জেনারেটিভ এআই’র ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে সামষ্টিক বহুমাত্রিক মৌলিক আইডিয়ার পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমে গিয়েছে। অর্থাৎ আমরা এখন আর আমাদের মেধা এবং সৃজনশীলতার ওপর জোর দেয়া কমিয়ে দিয়েছি। এখনই দেখা যাচ্ছে, অসংখ্য শিক্ষার্থী তাদের এসাইনমেন্টের পুরোটাই চ্যাট জিপিটিসহ আরও কিছু জেনারেটিভ এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, যেহেতু সব প্রশ্নের উত্তর এআই’র কাছে পাওয়াই যাচ্ছে তাহলে কষ্ট করে আর পড়ে লাভ কী? এখন যদি সব শিক্ষার্থী এই একইভাবে চিন্তা করে তাহলে একটা প্রজš§ যে মেধাশূন্য হয়ে পড়বে সেটা বলাই বাহুল্য। এর সমাধানের জন্য অবশ্য উন্নত দেশগুলো এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যাতে এই ধরনের কার্যক্রম সহজেই শনাক্ত করা যায়। কিন্তু আমাদের মতো তৃৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এখনও সেই সক্ষমতা তৈরি হয়নি। এতে দেখা যাচ্ছে, আমরাই বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছি।

সর্বোপরি বলা যায়, প্রযুক্তি একটি অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। এর সঙ্গে আমরা যত তাড়াতাড়ি তাল মিলিয়ে চলতে পারব, তত তাড়াতাড়ি আমরা উন্নতি করতে পারব। তাল মিলিয়ে না চললেই বরং আমরা পিছিয়ে পড়ব বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দুনিয়ায়। কিন্তু কোনো কিছুই যেন আমাদের সৃজনশীলতাকে ছাপিয়ে যেতে না পারে সেদিকেও আমাদেরকে লক্ষ রাখতে হবে। কেননা দিন শেষে জিনিয়াসই একটা দেশ বা একটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

নুসরাত জাহান পন্নি

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়